কেএম সবুজঃ চলমান শ্রমিক অসন্তোষের জেরে গতকাল সাভার ও আশুলিয়ায় ১১১টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুরে বিক্ষোভের জের ধরে ১৫টি কারখানা বন্ধ ও ছুটি ঘোষণা করা হয়। কাশিমপুর এলাকার বেক্সিমকো গ্রুপের কারখানার বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিগবস কারখানার গোডাউনে অগ্নিসংযোগ করে। এসময় তুরাগ গার্মেন্টস কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।
এদিকে আশুলিয়ায় বিভিন্ন দাবিতে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের জেরে ৫১টি তৈরি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল এই ঘোষণা দেয় সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া আরও ৬০টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের সড়ক অবরোধ বা বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়নি। তবে শিল্পাঞ্চলের অন্যান্য কারখানাসহ ঢাকা ইপিজেডের কারখানাগুলো চালু রয়েছে। সরজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশুলিয়ার কাঠগড়া থেকে জিরাবো এলাকায় অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানার মূল ফটকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার নোটিশ টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে আশুলিয়ার নরসিংহপুর, ইউনিক, জামগড়া, বেরন এলাকার হা-মীম গ্রুপ, শারমিন গ্রুপ, এনভয় কমপ্লেক্স, হলিউড গার্মেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড, স্টারলিং এ্যাপারেলস লিমিটেড, ভার্চ্যুয়াল বটয়ম, মণ্ডল নিটওয়্যারস লিমিটেড, সিগমা ফ্যাশনস লিমিটেড, ক্রশওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিস লিমিডেট, জিন্স প্রডিউসার লিমিটেড, অরুনিমা গ্রুপের অরুনিমা স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড, ডিএমসি এ্যাপারেলস লিমিটেড, এস এম নিটওয়্যারস লিমিটেড, আজমত গ্রুপের আজমত এ্যাপারেলস লিমিটেড, জেড-থ্রি কম্পোজিট নিটওয়্যার লিমিটেড ও জি-থ্রি ওয়াশিং প্যান্ট লিমিটেড, এনভয় কমপ্লেক্স, আগামী এ্যাপারেলস লিমিটেড, মানতা এ্যাপারেলস লিমিটেডসহ বেশকিছু কারখানার মূল ফটকে একই নোটিশ টানানো রয়েছে। নোটিশে বলা হয়েছে ‘গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পোশাক শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিতে কেন্দ্র করে গার্মেন্টস কারখানায় ভাঙচুরসহ হট্টগোল চলছে। বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে আমাদের কারখানায় ভাঙচুর চালানোর চেষ্টা করে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বুধবার থেকে শ্রম আইন-২০০৬ এর ১৩ (১) ধারা অনুসারে অনির্দিষ্টকালের জন্য ৫১টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলো। শ্রম আইন-২০০৬ এর ১৩ (১) ধারাতে বলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা বা বিভাগে বেআইনি ধর্মঘটের কারণে মালিক উক্ত শাখা বা প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারবেন, এমন বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকরা কোনো মজুরি পাবেন না। কয়েকটি কারখানায় শ্রমিকরা নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হলেও কারখানা বন্ধ থাকায় তারা চলে যান। বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সড়কে টহল দিচ্ছে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন কারখানার সামনে মোতায়েন রয়েছে অতিরিক্ত সেনা, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা। শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম জানান, সকাল থেকে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের কোথাও কোনো সড়ক অবরোধ, কারখানায় হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। সকালে সাভার-আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের প্রায় সব কারখানায় কাজে যোগ দেয় শ্রমিকরা। বেশির ভাগ কারখানাতেই উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে। তবে আগে থেকেই কিছু কারখানায় অভ্যন্তরীণ বেশকিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ চলছিল।
সেসব কারখানার শ্রমিকরা কাজে ফেরেনি: সাভার- আশুলিয়া ও জিরানি এলাকায় ৫১টি কারখানায় শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা অনুযায়ী বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র একজন পরিচালক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বন্ধ থাকা ১১৪টি কারখানার মধ্যে ১১১টি সাভার-আশুলিয়া ও জিরানি এলাকায়। অন্যদিকে শিল্পাঞ্চলে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কারখানাগুলোর সামনে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য। পাশাপাশি যৌথ বাহিনীর টহলও অব্যাহত রয়েছে।
ওদিকে গাজীপুরের অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানাসহ অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু থাকলেও ৩টি কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছে। শ্রমিক বিক্ষোভ চলাকালে একটি কারখানার গোডাউনে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। আগুন নিভাতে গেলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভাঙচুর করে ফিরিয়ে দেয়া হয়। বিক্ষোভের জের ধরে অন্তত ১৫টি কারখানা বন্ধ ও ছুটি ঘোষণা করা হয়।
গতকাল সকাল থেকে বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে গাজীপুরের চক্রবর্তী এলাকায় বেক্সিমকো গ্রুপের কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে চন্দ্রা-নবীনগর সড়ক অবরোধ করে। এর আগে মঙ্গলবারও বকেয়া বেতনের দাবিতে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকরা বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে। কারখানাটির মালিক কারাগারে আটক আওয়ামী লীগ নেতা সালমান এফ রহমান। শ্রমিকরা জানান, গত কয়েক দিন ধরে তারা গত মাসের বেতন-ভাতা প্রদানের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার বেতন দেয়ার কথা জানায় কারখানা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেদিন কিছু শ্রমিককে বেতন দেয়া হলেও বেশির ভাগ শ্রমিক বেতন পায়নি। সে কারণে তারা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন।
এদিকে, পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দিনভর চেষ্টা করে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাশের বিগবস পোশাক কারখানার গোডাউনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। আগুন নেভাতে গেলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। গাজীপুরের কাশিমপুর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন মাস্টার তাশারফ হোসেন জানান, বুধবার দুপুর ১টার দিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাশিমপুরের বিগবস পোশাক কারখানার গোডাউনে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। সকাল থেকেই পাশের কারখানা বেক্সিমকো গ্রুপে বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন চলছিল। তবে কারা আগুন ধরিয়েছে, এটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট পাঠানো হলে উত্তেজিত শ্রমিকরা গাড়ি ভেঙে দেয়। এতে আগুন নেভানোর জন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছতে না পেরে ফিরে আসে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট দুটি। এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তবে কারখানা শ্রমিকরা নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে গাজীপুর শিল্প পুলিশের বেক্সিমকো জোনের সহকারী পুলিশ সুপার মো. গোলাম মোর্শেদ জানান, বেক্সিমকো কারখানার আন্দোলন চলাকালে ওই এলাকার তুরাগ গার্মেন্টস কারখানায় ভাঙচুর করা হয়। বিগবস পোশাক কারখানায় হামলা চালিয়ে গোডাউনে আগুন দেয়া হয়। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে জিরানী এলাকার সব কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া আগে থেকেই চন্দ্রা এলাকার নায়াগ্রা টেক্সটাইল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। এদিকে, গাজীপুর সদর উপজেলার বাংলাবাজার এলাকার পারটেক্স বেভারেজ লিমিটেড, হোতাপাড়া এলাকার ফুওয়াং সিরামিক লিমিটেড, সিটি করপোরেশনের ভার্গো এম এইচ লিমিটেড পোশাক কারখানা ও শ্রীপুরের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরাও বিভিন্ন দাবিতে সড়কে নেমে বিক্ষোভ করেছেন। গত মঙ্গলবারের শ্রমিক আন্দোলনের জেরে ইতিমধ্যে জেলার অন্তত পাঁচটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছেন কর্তৃপক্ষ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- গাজীপুর সদর উপজেলার শিরিরচালা এলাকার এস এম নিটওয়্যার লিমিটেড, গিলারচালা এলাকার ফমকম ফ্যাশন, ফমকম প্রিন্টিং ও এমব্রয়ডারি কারখানা।এ বিষয়ে গাজীপুর শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার এসএম আজিজুল হক জানান, সদর উপজেলার বাঘের বাজার, শিরিরচালা এলাকার ৪-৫ কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেসব কারখানা খুলে দেয়া হবে। শ্রমিক অসন্তোষ, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, কারখানা ভাঙচুরের ঘটনায় গত সপ্তাহে গাজীপুরের বেশ কিছু কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার থেকে বিজিএমইএ’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ও সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে প্রায় সব কারখানা চালু করেন শিল্প মালিকগণ।