স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে চায়, যাতে কেউ পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, আমরা নিশ্চিত করতে চাই, আগামীর বাংলাদেশে আর কোনো ব্যক্তি এমনকি প্রধানমন্ত্রীও স্বৈরাচারী হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারবে না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীন মতামত নিশ্চিত করবে। আমরা মানবাধিকার, মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবো।
আজ বৃহস্পতিবার এক সেমিনারে ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কি করবে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। গুলশানের লেকশোর হোটেলের মিলনায়তনে বিএনপির উদ্যোগে ‘৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রুপরেখা ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এই সেমিনার আয়োজন করা হয়। সেমিনারে প্রথমে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের রুপরেখার পটভূমি তুলে ধরেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ। এরপর দলের তৈরি একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য এমন একটি রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা; যেখানে ইউটিউব, ফেসবুক এবং তাদের অনলাইন প্লাটফর্মে নিজের ভাবনা প্রকাশের কারণে কিংবা প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিষয়ে মন্তব্যের দায়ে কাউকে যেন হেনস্তা করা না হয়। সত্য গোপন করতে মেইন স্ট্রিম অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া যেন বাধ্য না হয়। এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে সেটি প্রচারেও সরকার কাউকে চাপ দেবে না। তবে দেশ গঠনের দায়িত্ব সবার। আমরা মিডিয়ার নিউট্রাল ও অবজেক্টিভ রোল প্রত্যাশা করি।’ গত ১৬ বছরে ‘গুম ও খুনে’র মাধ্যমের দেশে ভয়ের যে সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে তা বিএনপি নির্মূল করবে বলেও অঙ্গীকার করেন তারেক রহমান।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেটি নিশ্চিত করতে বিএনপি সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে চায়, যাতে কেউ পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন। আমরা আইন-বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে চাই। রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাজের জ্ঞানী-গুণীদের প্রতিনিধিত্ব এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দ্বি-কক্ষ বা বাই ক্যামেরাল পার্লামেন্ট সিস্টেম প্রবর্তন করতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য তরুণ বেকারদের কর্মসংস্থান। আর কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত যোগ্যতা অনুযায়ী বেকার ভাতা প্রবর্তন। আমরা নিশ্চিত করতে চাই সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ, তৃণমূলের ক্ষমতায়ন এবং আবারো ঐতিহাসিক খাল কাটা কর্মসূচি বাস্তবায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, শিক্ষা, জ্বালানি খাতে আমূল পরিবর্তন করে ‘দক্ষ জনশক্তি, রপ্তানিমুখী শিল্প বৃদ্ধি এবং জাতীয় রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও মেধাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে দলের পরিকল্পনাও তুলে ধরেন তারেক রহমান।
সংস্কার প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, ‘আলোচিত সব সংস্কার প্রস্তাবই ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সংস্কার বলতে সেটিই বুঝি- যে সংস্কারের মাধ্যমে সংবিধানের কয়েকটি বাক্যের পরিবর্তন নয়, বরং মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। একজন মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা হবে এবং তার ও পরিবারের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে।’
আমি সংস্কার বলতে সেটিই বুঝি- যা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রতিটি নারী ও পুরুষের বেকারত্বের সমস্যার সমাধান করবে, যে সংস্কার নারীদের সন্মান, স্বাধীনতা, ক্ষমতায় নিশ্চিত করবে, যে সংস্কার সব মানুষের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, যে সংস্কার দেশের সন্তানদের আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠন করবে, যে সংস্কার মানুষকে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা দেবে, যে সংস্কার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখবে। আমি সংস্কার বলতে সেটিই বুঝি, যা কৃষক-শ্রমিকসহ সব কর্মজীবী মেহনতি মানুষের ন্যায্য ও প্রাপ্য নিশ্চিত করবে।
বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর সমন্বয়ের প্রণীত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক-বৈষম্যহীন-সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই টার্মে নির্ধারণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সুপ্রিম কোর্টের জন্য আলাদা সচিবালয়, ন্যায়পাল নিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংযোজন-বিয়োজন বা পরিবর্তন করা হবে উল্লেখ করে তারেক বলেন, ‘সংযোজন-বিয়োজন বা পরিবর্তন অবশ্যই করা যেতে পারে। তবে তা হবে স্টেকহোল্ডার কনসালটেশন এবং পাবলিক কনসেনসাসের মাধ্যমে। সময়ের সঙ্গে এই ৩১ দফাই একদিন আমাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য তথা সুখী ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ অর্জনের দ্বার উন্মোচন করবে বলে বিশ্বাস করি। যা বিশ্ব মানচিত্রে পরিচিত হবে। কৃষিতে হবে স্বয়ং সম্পূর্ণ, শিল্পায়নে সাফল্যমণ্ডিত, অর্থনীতিতে গতিশীল, মানবসম্পদে সমৃদ্ধ এবং সামাজিকভাবে একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির একজন কর্মী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি- রাজনীতির উদ্দেশ্য কেবল ক্ষমতা নয়। বরং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন এবং জনগণের অভিপ্রায় বহিঃপ্রকাশেও এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের গড়ে তুলতে হবে একটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক বাংলাদেশ, আমাদের সবাইকে এক হয়ে এগিয়ে যেতে হবে বহু দূরে। এই অগ্রযাত্রার গতি হবে ফাস্ট অ্যান্ড স্পিডি। লক্ষ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট। জাতীয় ঐহিত্য ও অতীতের ভালো অর্জনগুলো ধারণ করে আমাদের চেতনায় ও দায়বদ্ধকে হতে হবে ভবিষ্যতমুখী।’
গণতান্ত্রিক ধারার রাষ্ট্র পরিচালনায় আবদ্ধ থাকলে চলবে না শুধু। আমাদের উৎসাহ দিতে হবে আধুনিকতাকে। বরণ করে নিতে হবে অভিনবত্বকে। সামনের দিকে দৃষ্টি তাক করে আলিঙ্গন করে নিতে হবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের চিন্তার ধারাকে, যা পরবর্তীতে পরিবর্তন করবে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে শামা ওবায়েদ ও ফারজানা শারমিনের সঞ্চালনায় সেমিনারে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জামায়াতে ইসলামীর রফিকুল ইসলাম খান, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, এনডিএমের ববি হাজ্জাজ, বাংলাদেশ লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, গণফোরামের অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, এবি পার্টির আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান ও অ্যাডভোকেটে এলিনা খান বক্তব্য দেন।
সেমিনারে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) আন্দালিব রহমান পার্থ, জামায়াতের হামিদুর রহমান আজাদ, জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের নুরুল আমিন বেপারী, গণসংহতি আন্দোলনের আবুল হাসান রুবেল, জাগপার খন্দকার লুৎফুর রহমান, রাশেদ প্রধান, এনডিপির আবু তাহের, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি মহিউদ্দিন ইকরাম, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের হারুন চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, ন্যাপ ভাসানীর আজহারুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনের আশরাফ আলী আকন্দসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও সেমিনারে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, জ্যেষ্ঠ নেতা আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আফরোজা খান রীতা, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, জহির উদ্দিন স্বপন, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, মাহবুবে রহমান শামীমসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, পাকিস্তান, ভারত, জাপান, সৌদি আরব, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক নুরুল আমিন, অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক শামসুল আলম সেলিমসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্র্রকৌশলী ও চিকিৎসক ও আইনজীবী ও সাংবাদিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন।