নিজস্ব প্রতিনিধি: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেগুলোতে আলোড়ন সৃষ্টি করা শব্দ হচ্ছে জুলাইয়ের আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড কে। ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের বক্তব্যে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উঠে এসেছে কয়েকজনের নাম। আমিও একজনকে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। সে ছিলো জুলাই আন্দোলন শুরুর মাস্টারমাইন্ড। সে আর কেউ না সে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে জুলাই আন্দোলন শুরুর প্রধান কারিগর আমার চোখে।
আমরা তাহলে আন্দোলন শুরুর প্রেক্ষাপটে যাই। জুনের শুরুতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে (ধারণা করছি ) হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে কোটাপদ্ধতি পুনর্বহাল করে হাইকোর্ট রায় দেয় তার প্রেক্ষিতে ছাত্ররা আন্দোলনে নামে। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে (আলটিমেটাম) দেয়। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে তারা সর্বাত্মক আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেয়। শিক্ষার্থীদের এই হুশিয়ারিকে সরকার পাত্তা না দিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতাবিরোধী প্রেতাত্মা বলে আখ্যা দিচ্ছিলো। আর তার সাথে শিক্ষার্থীদের তারা হাইকোর্ট দেখাচ্ছিলো। এদিকে স্বয়ং শেখ হাসিনা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলছে কোটাবিরোধী আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। একদিকে সে হাইকোর্ট দেখাচ্ছে অন্য দিকে সে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উস্কে দিচ্ছে নানাবিধ বিরূপ মন্তব্য করে। আপনারা একটু তার শাসন আমল ভালোভাবে নজর দিলে দেখবেন সে একটা বড় জিনিস চাপা দিতে ছোট ছোট ইস্যু বানায়।
আমরা আবার একটু জুনের ২২ তারিখে ফিরে যাই। বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে ভারতের রেল ট্রানজিট ও তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। এছাড়াও আরো ১০ টি সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই দেশ।শেখ হাসিনা জানতো বাংলাদেশের মানুষ ভারতের রেল ট্রানজিট বাংলাদেশের ভূখন্ডের উপর দিয়ে যাবে এটা মেনে নিবে না। তাই সে এবার ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে কোটাকে। বাংলাদেশের সবাই জানেন কিছুদিন আগেও সব সময় পত্রিকা এবং টিভিতে প্রধান বিষয় ছিলো রাসেল ভাইপার সাপ। আন্দোলনের পর থেকে আর এই সাপ নিয়ে কোনো নিউজ আমার চোখে পরে নাই। আমার চোখে রাসেল ভাইপার সাপও একটা ইস্যু ছিল যা কোনো কিছুকে ধামাচাপা দিতে ব্যবহৃত হয়েছে। শেখ হাসিনা ছিলো একজন দাম্ভিক মানুষ। সে তার দাম্ভিকতা আর অহংকারের জন্য একটা সিম্পল দাবীকে বড় বানিয়ে তার পতন নিশ্চিত করলো। ইতিহাস থেকে জেনেছি যারা মানুষের অধিকার হরণ করে তাদের পতনের ইস্যু হয় ছোট। তারা অনেক ছোট ইস্যুকে অনেক বড় করে নিজের পতন নিশ্চিত করে। ইতিহাস বলে যারা এই রকম স্বৈরশাসক মানুষের অধিকার হরণ করে তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে দুইটা জিনিস সৃষ্টি করে। একটা হতাশা আর অন্যটা ভীতি। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেনো যতই জীবন দেই না কেনো ওনাকে সরানো যাবে না এই হতাশা আর ভীতি এই দুইটা জিনিস শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অনেক অংশে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো।কেউ তার কোনো বিষয়ে বিপক্ষে মুখ খুললেই তার উপর নেমে আসতো কঠিন নির্যাতন।
আমরা একটু শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলের দিকে তাকালে দেখতে পাবো ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণ, বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও পুলিশি নিপীড়ন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠন, সরকার ঘনিষ্ঠদের ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থপাচার, সচিবালয় থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দলীয়করণ, দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি, ভারতের সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি কারণে সৃষ্ট গভীর জন অসন্তোষ।তার আমলে বিভিন্ন সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, জনসংখ্যা, মাথাপিছু আয়, কৃষির উৎপাদন ও ভোগ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইত্যাদি বহু পরিসংখ্যানে জালিয়াতি করা হয়। হাসিনার শাসনামলে রীতিমতো আইন করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। এ জন্য ব্যবহার করা হয় ২০১৩ সালে সংশোধিত আইসিটি অ্যাক্ট-২০০৬, ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং ২০২৩ সালে প্রণীত সাইবার নিরাপত্তা আইন। এসব আইনের মাধ্যমে 'ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা', 'মানহানি', 'মিথ্যা তথ্য প্রচার', 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত', 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'র বিরোধিতা করা ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই যে কাউকে আটক ও অনির্দিষ্টকাল কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। গণমাধ্যমের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বানোয়াট পরিসংখ্যান আর বিভিন্ন দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নকেন্দ্রিক প্রচারণার মাধ্যমে দুঃশাসনকে আড়াল করার চেষ্টা করে সে।
এখন ঘটনায় আসি : একদিকে সে ইন্ডিয়ার সাথে তার চুক্তি মতো কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর অন্য দিকে সে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উস্কে দিচ্ছে। সে চাচ্ছিলো এই আন্দোলন চলতে থাকুক আর তার সাথে ইন্ডিয়ার চুক্তি মোতাবেক ট্রেনের লাইনের কাজটা শুরু হোক। কিন্তু সে তখনও বুঝতে পারে নাই এই আন্দোলনটা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে। এক সময় সম্পূর্ণ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামতে শুরু করলে সে আগের পদ্ধতি অনুযায়ী তার পুলিশ বাহিনী এবং তার দলের লোকদের আন্দোলন দমন করতে নামায়। কিন্তু কোনমতেই সে এই আন্দোলনের স্পিরিট কমাতে পারছে না। দিন যত যাচ্ছে এই আন্দোলন তত বড় হচ্ছে। এক সময় সকল রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার, নানা বয়সের লাখো মানুষ অংশ নিতে শুরু করে এই আন্দোলনে। তখন এই আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রুপ নেয়। এক সময় তার সময় ফুরিয়ে আসে। অবশেষ সে ৫ই আগষ্ট দুপুর ২ টায় পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগ যে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছিল, প্রায় ৫০ বছরের মাথায় দলটি আবার সেই একই অবস্থায় পড়েছে।
আমার চোখে সে ভেবেছিলো ছোট একটা ইস্যু করে তার কাজটা হাসিল করবে।কিন্তু সাথে সাথে সে আরেকটা ভুল করে বসে শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে গুলি করে। সে ভেবেছিল যেভাবে এই ১৬ বছর বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নিপীড়ন করে আটকে রাখছিলো সেভাবেই এই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপরও তাই করে তার কাজ হাসিল করবে। ইতিহাস বলে তুমি যদি জয়ের নেশায় হারিয়ে যাও তাহলে এক সময় হেরে যাওয়ার শক্তিটুকুও থাকবে না। শেখ হাসিনার প্রতিটা ক্ষেত্রে জয় ছিলো শতভাগ। সে নিজেই খেলা সাজাতো। পরে সে নিজেই সেই খেলায় অংশগ্রহণ করতো। মনে রাখতে হবে এক সৈন্য দিয়েও রাজাকে বদ্ধ করা যায়। খেলার পাশার দান সব সময় নিজের দিকেই হয় না। মাঝে মাঝে পাশার দান উল্টে যায়। শেখ হাসিনাকে মাস্টারমাইন্ড বলার প্রধান কারণ এইটাই। সে নিজের সাজানো চালে নিজেই নিজের পতন ডেকে এনেছে
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ এ্যাড. নজরুল ইসলাম । ২০২০ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | দৈনিক ভোরের খবর,খন্দকার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান। অফিসঃ ১৫০ নাহার ম্যানসন (৫ম তলা) মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকা,ঢাকা -১০০০। বার্তাকক্ষ-+৮৮০১৭৪৫-৩৫৪২৭৭