ভোরের খবর ডেস্ক: প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করেছে সরকার। কমিটির অন্যান্য সদস্যগণের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন সচিব খোন্দকার মো. আসাদুজ্জামান, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর প্রাক্তন মহাপরিচালক মো. রফিকুজ্জামান, প্রাক্তন অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ, গণসাহায্য সংস্থার পরিচালক (শিক্ষা) বেগম সামসি হাসান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ইরাম মারিয়াম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব মোরশেদ এবং গাইবান্ধা, সুন্দরগঞ্জ শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক নূরুল আলম। সাদা চোখে এই কমিটিতে দুজন শিক্ষাবিদ, তিনজন সরকারি কর্মকর্তা (আমলা), তিনজন এনজিও প্রতিনিধি এবং একজন শিক্ষকের উপস্থিতি দেখা গেলেও অন্তর্গতভাবে এ কমিটিকে ‘এনজিও-আমলা-কর্পোরেট প্রভাবিত’ হিসেবে আখ্যায়িত করার সুযোগ রয়েছে। এ কমিটির প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায় যে, নবগঠিত কমিটির দুটো বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে যা দিয়ে বহুধাবিভক্ত প্রাথমিক ও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ধারাসমূহকে সার্বজনীন ধারায় নিয়ে আসা দূরহ ও সময়সাধ্য বিষয়, এসব বিষয় চেপে রেখে শিক্ষার মানোন্নয়ন ‘দুর কি বাত’! প্রথমত, এ কমিটি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিদ্যমান আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ধারাসমূহ এবং প্রাতিষ্ঠানভিত্তিক অংশিজনের অন্তর্ভূক্তির নিশ্চয়তা দেয়না। ফলে আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের মতামত নেয়া হলেও দিনশেষে প্রাথমিক শিক্ষার মনোন্নয়নে মৌলিক পরিবর্তন করার মতো নীতি, কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার যে সক্ষমতা দরকার – তা এ কমিটির মাধ্যমে সম্ভব হবে কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। দ্বিতীয়ত, দেশের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন, অবৈতনিক ও একই ধারায় গণমূখী করার যে রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা রয়েছে তার ব্যবচ্ছেদ অব্যাহত থাকবে বলে অনুমান করা যায়। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষার সকল ধারাকে গণমূখী ও অবৈতনিক করার লক্ষ্যে যে সংস্কারের বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করবে তা স্পষ্ট নয়। সম্প্রতি ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে সাম্য ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মানের যে গণআকাংখার তৈরি হয়েছে এ ধরণের এনজিও-আমলা-কর্পোরেট কমিটির মাধ্যমে তা উপেক্ষা এবং অবজ্ঞা করার অভিযোগ উঠতে পারে বলে আশংকা করি।
কেন এসব সমস্যা নবগঠিত কমিটির মাধ্যমে সুরাহা করা সম্ভব নয় তা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যায়। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারায় প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে ‘অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক’ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এই মানবাধিকার সনদটি বিশ্ব-সম্প্রদায়ের সাথে রাষ্ট্রের চুক্তি যা থেকে আজকের বাংলাদেশ সরে আসতে পারে না। ২০০৯ সাল অবধি বিশ্বের ১৩৫ টি দেশ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশ্বজনীন এ অধিকারকে রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা সুরক্ষিত করলেও বাংলাদেশে অদ্যাবধি তা সম্পন্ন করতে পারে নাই। ১৯৯০ সালে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন (Compulsory Primary Education Act 1990) জারি করা হলেও বাস্তবে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে এ আইনের কোনো কার্যকারিতা নাই। প্রকৃতার্থে এ আইন প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশগম্য শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। দেশে ১৩ টি পৃথক ধরণের প্রাথমিক শিক্ষা এবং ২৪ ধরণের পৃথক মানের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে! এছাড়াও বিপুল সংখ্যক কওমী ও ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যার আওতায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পৃথক শিক্ষাক্রমের আওতায় অধ্যয়নরত। ক্রমশঃ এসব আনুষ্ঠানিক-উপ-আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক ধারাটি বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “যথাযোগ্য আইন দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা এখনও রাষ্ট্র কর্তৃক যথাযোগ্য আইনের দ্বারা কার্যকর নয়। প্রাথমিক শিক্ষার মান নির্ধারণে ইউনেস্কো নির্ধারিত পাঁচটি মানদণ্ডে (অবকাঠামো, ইনরোলমেন্ট, ড্রপ-আউট, শিক্ষক যোগ্যতা, আর্থিক বরাদ্দ) এদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মানগত অবস্থা এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সহ সমগ্র বিশ্বের উন্নত-দ্রুত উন্নয়নশীল এমনকি অনুন্নত অনেক রাষ্ট্রের তুলনায় নিম্নসারিতে অবস্থিত। এই নিম্নমান ক্রমশঃ অবনতির দিকে যাচ্ছে মর্মে প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট। এমতবস্থায় নবগঠিত কমিটি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সার্বজনীন ও গণমূখি করার ক্ষেত্রে কতটুকু ও কোন কোন মাত্রায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে সে প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি প্রশ্ন করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
নবগঠিত কমিটি কি বিদ্যমান বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত প্রাথমিক শিক্ষাকে সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের বিষয়টি তাঁদের কার্যতালিকায় অন্তর্ভূক্ত করবেন?
কওমী মাদ্রাসা ও ইংরেজী মিডিয়াম শিক্ষা ধারা নিয়ে কমিটি কোনো সংস্কার প্রস্তাব তাঁদের কার্যতালিকায় অন্তর্ভূক্ত করবেন?
প্রাথমিক শিক্ষায় বহুধাবিভক্তি, বৈষম্যপূর্ণ আর্থিক বরাদ্দ, শিক্ষা শাসনকার্য পরিচালনায় আইনি পরিকাঠামোর সংস্কার ও মানোন্নয়ন বিষয়টি তাঁদের কার্যতালিকায় অন্তর্ভূক্ত করবেন?
সর্বোপরি এ ধরণের সীমিত পরিসরের কমিটি দিয়ে প্রাথমিক ও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মতো বিস্তৃত ব্যবস্থার সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ন এবং মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ কতটুকু প্রতিনিধিত্বশীল ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে তা বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করি।
আরো একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন যে, উপরিল্লিখিত প্রশ্নগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া কি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য যুক্তিযুক্ত?
আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, এ জাতি একসাগর রক্তের বিনিময়ে দেশকে বৈষম্যের কবল থেকে মুক্তির আকাংখা নিয়ে একটি সাম্য ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে। সুতরাং প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কার কর্মসূচিকে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার বুনিয়াদ হিসেবে গণ্য করে এর মৌলিক সংস্কারের ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে হবে এবং একটি মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় তা জনগণের সাথে সরকারের দায়বদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে মনে করি।
শিক্ষা সংস্কার ও মানোন্নয়নে বিগত ৫৩ বছর ধরে সরকারের হঠকারী পদক্ষেপের ভরি ভরি দৃষ্টান্ত রয়েছে, তার দু-একটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরছি। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরে সর্বমোট ৮টি শিক্ষা কমিশন/শিক্ষা কমিটি গঠিত হয়েছে। এ সব শিক্ষা কমিশন/কমিটি গঠনের সময় অনেক গালভরা বুলি আওড়ানো হয়েছে। শিক্ষার আমূল পরিবর্তনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। ‘পরিবর্তনের রেখাচিত্র, যেতে হবে বহুদূর’ এমন দ্যোতনা তৈরির নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে দেশ-বিদেশে প্রচার চালানো হয়েছে। অথচ দেখা গেছে যে, গঠিত ৮টি শিক্ষা কমিশন/কমিটিই তাঁদের কমিশন/কমিটির রিপোর্ট গণমাধ্যমে প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য না হয়েছে কোন কর্মপরিকল্পনা আর না হয়েছে তার অগ্রগতি প্রকাশের ব্যবস্থা! ফলে বহু সংস্কার প্রস্তাব কোন পর্যালোচনা ছাড়াই বছরের পর বছর অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। এর একটি জলন্ত প্রমাণ হচ্ছে জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ এ প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বিদ্যমান ৫ বছরের স্থলে ৮ বছর করা হয়। এই শিক্ষানীতি ঘোষণার ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও এ সংক্রান্ত কোনো অগ্রগতি নেই। এ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করা সাধ্য নয়, সম্ভবও নয় (Neither Feasible nor Possible) মর্মে পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরণের আরো একটি উদাহরণ হচ্ছে সৃজনশীল প্রশ্নমালা প্রণয়নের মাধ্যমে সৃজনশীল জাতি গঠনের মুখরোচক ও বুলিসর্বস্ব ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প। ফলাফল কী হয়েছে? আজ আমরা সকলেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি সৃজনশীল প্রশ্নমালার নামে মানহীন সিজিপিএ’র ছড়াছড়ি। খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি ) তাদের মূল্যায়নে যে কথাটি লিখেছে তার সরল তরজমা হলো, “সৃজনশীল পদ্ধতির নামে আমরা রীতিমতো ৮০০ কোটি টাকা জলে ফেলে দিয়েছি”। এ হচ্ছে বাংলাদেশে শিক্ষার মানোন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপের সাফল্যের নমুনা!
প্রাথমিক শিক্ষায় সংস্কার ও মানোন্নয়ন করতে হলে সর্বাগ্রে এ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র ও বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে অবহিত হওয়া জরুরি। ব্যানবেইজ রিপোর্ট- ২০১৩ অনুযায়ী ৮ বছরে (২০০৫-২০১২) প্রাথমিক শিক্ষায় নেট ড্রপ-আউট রেট গড় ২৬.২%, কো-এফিশিয়েন্ট অব পারফরমেন্স বালকদের জন্য ৫৮% থেকে ৭৫.৬% এবং বালিকাদের জন্য ৬৩-৭৯% যা OECD ভূক্ত দেশসমূহ এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সমূহের মধ্যে নিম্নমান নির্দেশ করে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী বেরিয়ে যাওয়া বা ঝড়ে পড়া বিষয়ক এক ভয়ংকর তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল সর্বমোট ৪.৩ মিলিয়ন যা ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবার সময় ০.৭৪ মিলিয়নে নেমে আসে আর মাত্র ০.৫৩ মিলিয়ন উত্তীর্ণ হয়। অর্থাৎ প্রগ্রেশন রেট মাত্র ১২% আর ফেইলিয়র রেট ৮৮%। অর্থাৎ ৮৮% শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণি থেকে এসএসসি পাশের আগেই শিক্ষা জীবন থেকে হারিয়ে যায়। এর কোনো হদিস রাখার কোনো প্রয়োজন আমাদের কারো না থাকলেও ৪৩ লক্ষ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৮২ হাজার শিক্ষার্থী এ+ প্রাপ্তির ঠেলায় সারা দেশের মিষ্টির দোকান ঠিকই শুন্য হয়ে যায়! এ ধরনের উল্লাস হায়দার আলীর গান মনে করে দেয়, “নিমর্মতা কতো দূর হলে জাতি হবে নির্লজ্জ”। নীতি নির্ধারক আর সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার এই রুগ্ন দশায় উল্লাস আর সাফল্যের কীর্তণ করা নির্মমতা ছাড়া আর কী বলা যায়? এ অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই করতে হবে।
দেশে যে ১৩/১৪ ধরণের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে তাতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ইনরোলমেন্ট হার ৫২.৪% নতুন নিবন্ধিত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২২%, অনিবন্ধিত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২.৩%, পরীক্ষামূলক বিদ্যালয়-০.৫৬%, এবতেদায়ী মাদ্রাসা -১.৭৬%, কিন্ডারগার্টেন -৯.২%, এনজিও স্কুল -১.১%, কমিউনিটি স্কুল-১.১%, মাদ্রাসা সংযুক্ত এবতেদায়ী মাদ্রাসা-২.১%, হাইস্কুল সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়-২.৪%, ব্রাক সেন্টার -১.১%, রোজ স্কুল -০.৪৭%, শিশু কল্যান প্রাথমিক বিদ্যালয়-০.০৬%, অন্যান্য-০.২২%। এ ছাড়াও রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিকাশমান সামাজিক ধারার কওমী মাদ্রাসা এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত সরকারি প্রতিষ্ঠান সমুহে গড়ে ৪৭ হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরো ভয়াবহ। অথচ ভারতে এই হার ৩৬ (২০১৪ সালে) যা তারা পরবর্তী ৪ বছরে ৩০ এ উন্নীত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। OECD দেশসমুহের ৬ টি দেশে এই হার যথাক্রমে মালয়েশিয়া ও জার্মানীতে ১২, আমেরিকা ও ফিনল্যান্ড ১৪, জাপানে ১৭, ফ্রান্স, কোরিয়া ও যুক্তরাজ্যে ১৮ এবং অষ্ট্রেলিয়ায় ১৯। শিক্ষার্থী শিক্ষক অনুপাতের এই রুগ্নতার সাথে যুক্ত হয়েছে দূর্বল মানের শিক্ষক। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহে শিক্ষক নিয়োগে কোনো আলাদা কমিশন বা সংস্থার পরিবর্তে ‘সরকারি নির্বাহী আদেশে’ শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা স্টাইপেন্ড প্রকল্পের প্রতিবেদন- ২০১৪ মোতাবেক দেখা যায় যে প্রাথমিক শিক্ষকতায় ৫৭% মহিলা শিক্ষকের যোগ্যতা এইচএসসি পাশসহ সাটিফিকেট অথবা ডিপ্লোমা-ইন-এডুকেশন, যখন কিনা অবশিষ্ট শিক্ষককের শিক্ষাগত যোগতা এসএসসি পাশ! বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকতায় নিয়োজিত শিক্ষকদের যোগ্যতা না বলাই উত্তম! শিক্ষক সংখ্যার অপ্রতুলতা এবং শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিদ্যমান দুরাবস্থার নীতিগত পরিবর্তন না করে শিক্ষার মানোন্নয়ন এক অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। সাম্প্রতিক আরো একটি প্রতিবেদনে (BPE Performance Report-2014) দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৩% কক্ষ ক্লাস গ্রহণের উপযুক্ত (ভালো) মর্মে পাওয়া গেছে। মাত্র ২১% সরকারি স্কুলের ক্লাসরুম ৪০ জন ছাত্রের মানসম্পন্ন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ স্কুল সমূহের মধ্যে ৭৮% স্কুলের পানি সরবরাহ টিউবওয়েল এর মাধ্যমে যার মধ্যে ৭২% আর্সেনিক মুক্ত, ২১% আর্সেনিকযুক্ত এবং ৭% টেষ্ট ছাড়া। সরকারি বিদ্যালয় সমুহের ৬২% স্কুলে ছাত্রীদের আলাদা টয়লেট সুবিধা রয়েছে। ভালো শিখন নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট এবং অভ্যন্তরীণ রাস্তা সংযোগের বিষয়গুলি এখনও প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহের সূযোগের মধ্যে বিবেচনায় আসেনি। এ তো হলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহের অবস্থা যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর ৫২.৪% মাত্র। বাকি নন-রেজিষ্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর কি অবস্থা তার গ্রহনযোগ্য তথ্যের অভাব রয়েছে। শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দে আমাদের রুগ্নতা (ডিজিপি’র ২% এর নীচে) এশিয়া-পেসিফিক অঞ্চলে নিম্নে, এমনকি আফ্রিকার কয়েকটি দরিদ্র দেশের স্তরে নেমে এসেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এতো বৈষম্য ও রুগ্নতা রেখে একটা জাতিকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলা যাবে সে এক বিরাট জিজ্ঞাসা! তবে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষাকে যদি আমরা উপলদ্ধি করি, তাহলে অবশ্যই জাতি গঠনের এ মাহেন্দ্রক্ষণে শিক্ষার সকল স্তরে বিরাজমান বৈষম্যকে দূর করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের প্রয়াস চালাতে হবে। হতে পারে তা দীর্ঘমেয়াদি। তবে উপযুক্ত ও বাস্তবসম্মত কর্মপরিল্পনা গ্রহণ করা হলে বৈষম্যহীন জাতি গঠন অসম্ভব নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত কোনো হঠকারী পদক্ষেপের ফলে যেন এ মহান বৈষম্য বিরোধী অভিযাত্রা ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়। দুঃখ ও আশংকা নিয়েই বলতে হচ্ছে, গঠিত কমিটি অতীতের মতই বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে তবে জাতির আকাঙ্ক্ষা মোতাবেক একটি সার্বজনীন, গণমূখি একিভূত শিক্ষার বুনিয়াদ রচনার সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হলে এ কমিটিকে আরো অন্তর্ভূক্তিমূলক এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ঠ সকল মহলের প্রতিনিধিত্বশীল হতে হবে। বিষয়টি অবশ্যই সরকারের দায়িত্বশীল মহলকে ভেবে দেখার অনুরোধ করবো।
লেখক-
প্রফেসর জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস
ই-মেইল- syedaziz61@gmail.com