ভোরের খবর ডেস্ক: কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল কলেজ শিক্ষার্থী জিহাদ হাসান মাহিম। আন্দোলন যখন একদফায় গড়ায় তখন যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছিল টানা সংঘাত সহিংসতা। ভয় থেকে মাহিমের মা কোহিনুর বেগম ছেলেকে বারণ করেছিলেন আর আন্দোলনে না যেতে। মাহিম বলেছিল মা আর একদিন মাত্র আন্দোলনে যাবো। ৫ই আগস্ট মাকে লুকিয়ে আন্দোলনে যায় সে। এরপর আর ঘরে ফিরতে পারেনি। ঘরে ফিরে মাহিমের গুলিবিদ্ধ লাশ। গত ৫ই আগস্ট দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন জিহাদ হাসান মাহিম। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রাণ হারানো শিক্ষার্থী মাহিমের বাবা মোহাম্মদ আলম মিয়া ছেলের শোক বয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে তিনি গর্বও বোধ করেন ছেলের আত্মত্যাগে।যাত্রাবাড়ী থানাধীন শনির আখড়া এলাকায় তাদের বাসায় গিয়ে দেখা যায় শোকবিহ্বল পরিস্থিতি।তার বই খাতা, খেলার সরঞ্জাম বুকে আঁকড়ে ধরে যেন ছেলের স্পর্শ অনুভব করতে চাইছেন শোকার্ত পিতামাতা। কান্নায় ভেঙে পড়ে পিতা মোহাম্মদ আলম মিয়া বলেন, ‘গত ১৯শে জুলাই আন্দোলনে গিয়ে সে ছররা গুলিতে আহত হয়েছিল। আমি তাকে বলি, আন্দোলনে গিয়ে তোর কিছু হলে আমাদের কী হবে? ছেলে উত্তর দিলো, আমরা ঘরে বসে থাকলেই বা তোমাদের কী হবে! দেশটাকে পরিষ্কার করতে হবে। সেটা আমরা ঘরে বসে থাকলে হবে না। আমি বলি, তাহলে তুই একা যাবি না। আমি আর তোর ছোট ভাইও সঙ্গে যাবো।মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘আমি স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী মানুষ। কষ্ট হলেও আমার সীমিত সামর্থ্যে ছেলের স্বপ্ন পূরণে চেষ্টা করে গেছি, নিজে স্বপ্ন দেখেছি। ছেলে হারিয়ে এখন আমার চারদিক অন্ধকার!’ জিহাদ হাসান মাহিমের বয়স হয়েছিল ১৮ বছর। রাজধানীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন জিহাদ। অঝোর কান্নায় মাহিমের মা কোহিনুর বেগম বলেন, ‘সবাই বলছিল ৫ই আগস্ট পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হবে। আগের দিন ছেলেকে বলি, তুই আন্দোলনে আর যাবি না। আমার খুব ভয় লাগছে। ছেলে বললো, আর এক দিনই যাবো মা। সেদিন সকাল থেকেই ছেলেকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করছিলাম। সে বাসায় ছিল। আমাকে ডিম সেদ্ধ করতে বললো। কিন্তু আমি যেন বুঝতে না পারি সে বাইরে যাবে, এজন্য হয়তো এক ফাঁকে মোবাইল বাসায় রেখে এবং নাস্তা না খেয়েই বেরিয়ে যায়। দুপুরের পর থেকে বাড়ির সামনে রাস্তায় দলে দলে মানুষের আনন্দ-হৈ হুল্লোর টের পাই। আমার ছেলেটা মোবাইল ফোন বাসায় রেখে যাওয়ায় তার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল না। আমি ভাবলাম, বন্ধুদের সঙ্গে সেও হয়তো আনন্দ-উল্লাসে মেতেছে। হয়তো কোথাও ঘোরাঘুরি করছে।জিহাদের ভগ্নিপতি তানভীর আহমেদ হিমু জানান, যাত্রাবাড়ী থানার কাছে গুলিবিদ্ধ জিহাদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান শান্ত, নোমান, মনিরসহ তরুণ বয়সের কয়েকজন। তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ায় ময়নাতদন্ত চাননি তারা। জিহাদের মরদেহ হাসপাতাল থেকে তারা নিয়ে যান দনিয়া জামে মসজিদে। তখনো তার পরিচয় অজ্ঞাত। পরে জিহাদের মরদেহের ছবি তুলে রাত ১০টার দিকে এক ফেসবুক পেজে পোস্ট দেয়া হয়, কেউ চেনে কিনা। পরে একজন চিনতে পেরে কল দিয়ে জিহাদের পরিবারকে জানায় সেই পোস্টের ব্যাপারে।কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার সুন্দলপুর ইউনিয়নে জিহাদ হাসানের গ্রামের বাড়ি। সেখানে দাদার কবরের পাশে শায়িত করা হয়েছে তাকে। জিহাদকে নিয়ে এখন গর্বিত পরিবারের সদস্যরা। তিন ভাই বোনের মধ্যে জিহাদ দ্বিতীয়। ছোট ভাই তাহমিম হাসান যাত্রাবাড়ী এলাকার বর্ণমালা আদর্শ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বড় বোন রাজধানীর বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আফরিন বিনতে আলম মিম বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মনটা ছিল অনেক বড়। যেকোনোভাবে সমাজসেবা করতে চাইতো সে। জিহাদ ছিল সদাচারী এবং অত্যন্ত মেধাবী। কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হয়ে জিহাদ বলেছিল, ভবিষ্যতে সে চাকরি করবে না, ব্যবসা করবে। অনেক কর্মসংস্থান করবে। বন্ধুদের কাছে সে বলতো, আব্বুর বয়স হচ্ছে তাকে বেশিদিন চাকরি করতে দেবো না। শিগগিরই আমার কিছু করতে হবে।’জিহাদের বাবা মোহাম্মদ আলম জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে শুরু থেকেই জিহাদ সোচ্চার ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রত্যেক কর্মসূচিতে ছিল তার সরব অংশগ্রহণ। মৃত্যুর ২ দিন আগে তার ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে জিহাদ লিখেছিলেন, ‘গন্তব্য একটাই। হয় দেশের কাফনের কাপড় শেষ হবে, অথবা মিষ্টির দোকান খালি হবে।’মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘আদর করে ছেলের নাম রেখেছিলাম জিহাদ। কে জানতো ছেলে আমার বিপ্লবী হবে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রাণ দেবে! আন্দোলনে প্রাণ হারানো শিশু-কিশোরদের জন্য সবসময়ই দোয়া করেছি। আমার সন্তানও চলে যাবে ভাবিনি। আমাদের সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে এখন শুধু সুন্দর একটা দেশ চাই।’
✅ আমাদের প্রকাশিত কোন সংবাদের বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ বা পরামর্শ থাকলে ই-মেইল করুনঃ dailyvorerkhabor@gmail.com
❌ বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।