নিজস্ব প্রতিনিধি: মো. ইয়াসিন শিকদার (২৩)। পেশায় পিকআপের হেলপার।আন্দোলনের প্রভাবে কাজ না থাকায় গত শনিবার সকাল থেকে মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী এলাকায় ভাইয়ের বাসাতেই ছিলেন। দুুপুরের পর সদাই কিনতে লুঙ্গি পরে মাজায় মানিব্যাগ গুঁজে বাসা থেকে বের হয়ে সামনের মুদি দোকানে যান। কিছুটা দূরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি দেখে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরছিলেন। তার আগেই পেছন থেকে একটি গুলি এসে লাগে ইয়াসিনের মাজায়। গুলিটি তার পেটের নাড়ি ছিঁড়ে সামনে দিয়ে বের হয়ে যায়। আহত ইয়াসিনকে স্বজনরা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। এরপর থেকে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪২০ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৭ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। নাড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায় পেটে ব্যাগ বেঁধে দিয়েছেন ডাক্তার।ডান পা সম্পূর্ণ অচল। বেডে খাওয়া, বেডেই সব। তার বড় ভাই মো. মিজানুর বলেন, আমাদের বাড়ি পিরোজপুরের নাজিরপুর। চার ভাইবোনের মধ্যে ইয়াসিন ছোট। সকলের আদরের। বোন দুটোর বিয়ে হওয়ার পর বাবা-মা দেশে থাকলেও ইয়াসিন আমার কাছে ঢাকায় চলে আসে। কাজ শেখার জন্য ওকে পরিচিত একটি পিকআপ চালকের হেলপারির কাজে দেই। সবকিছু ঠিকই চলছিল। ও কোনো আন্দোলনেও যায়নি। কাজ ছিল না বলে বাসায়ই ছিল। দুপুরের পর মুদি দোকানে সদাই আনতে যায়। আর এর মধ্যেই এই অবস্থা। তিনি বলেন, আমরা দিন আনি, দিন খাই। এর মধ্যে ভাইটা গুলি খেয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে। ওষুধ, ব্যান্ডেজ, পেটের ব্যাগ সব মিলে এখন পর্যন্ত ৬০-৭০ হাজার টাকা ধারদেনা করা হয়েছে। সামনে কী হবে কিছুই বুঝে ওঠতে পারছি না। ইয়াসিনের বাবা রউফ শিকদার বলেন, কিছু না করে, কোথাও না গিয়ে বাসার সামনে থেকে গুলি খেয়ে আজ আমার ছেলেটা হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে। কবে সুস্থ হবে, কবে কী করবে আদৌ আগের মতো জীবনযাপন করতে পারবে কিনা- এসব নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। এদিকে বৃহস্পতিবার মিরপুর-২ নম্বর এলাকার মোহনা গার্মেন্টসের বন্ধ গেটের বাইরে থেকেই ভেতরে থাকা পোশাক শ্রমিকদের ওপর গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে গার্মেন্ট শ্রমিক মো. শফিকুল ইসলামের পায়ের গোড়ালির মাংস ছিন্ন হয়ে যায়। তিনিও গত আটদিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালের ৪২০ নম্বর ওয়ার্ডে। সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বার শফিক বলছিলেন- আমার মেয়ে আছে, পরিবার আছে। কথা বললে যদি তাদের সমস্যা হয়। আশ্বস্ত হওয়ার পর শফিক বলেন, আমি পরিবার নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর শেখেরটেক এলাকায় থাকি। আর কাজ করি মিরপুর-২ এর মোহনা গার্মেন্টে। গত বৃহস্পতিবার বিকালে আমাদের গার্মেন্ট ছুটি হয়ে গেলেও রাস্তায় সংঘর্ষ চলায় আমরা বের হচ্ছিলাম না। গার্মেন্টের ভেতরই ছিলাম। এক পর্যায়ে ছয়তলা গার্মেন্টের উপর থেকে দেখি রাস্তায় লোকজন একটু কম। তখন আমিসহ আরও কয়েকজন নিচে নামছিলাম। এরই মধ্যে কয়েকজন লোক আমাদের গার্মেন্টের গলি দিয়ে দৌড় দেয়। আমাদের গেট তখনো বন্ধ ছিল। আর গেটের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। হঠাৎ গেটের বাইরে থেকে উপর দিয়ে গুলি শুরু করে পুলিশ। গেটের নিচের ফাঁকা জায়গা দিয়েও গুলি ছোড়ে তারা। সেই গুলি এসে লাগে আমার পায়ে। সঙ্গে ডান পায়ের গোড়ালির মাংস ছিঁড়ে দুই ভাগ হয়ে যায়। আমার সহকর্মীরা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এখানে আসার পর প্রথমে ছিঁড়ে যাওয়া মাংস এক করে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়। এরপর সেই মাংসে পচন ধরে। সেগুলো আবার কেটে বাদ দিয়ে ডেসিং চলছে। একটু ভালো হলে থাইয়ের (উরু) মাংস নিয়ে পায়ে লাগানো হবে। তিনি বলেন, ডাক্তার বলেছে অন্তত তিন মাস আমি আর কিছুই করতে পারবো না। কিন্তু আমার তো পরিবার আছে। এই ক’দিনেই ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এরপর বাসা ভাড়া। পরিবারের খরচ। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলো পরিবার নিয়ে কীভাবে কাটাবো- তাই নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছি। বিউবিটি ইউনিভার্সিটির বিবিএ’র ছাত্র মো. মোমিনুল গত বৃহস্পতিবার বিকালে ধানমণ্ডি সোবহানবাগের বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন পাউরুটি কেনার জন্য। এর মধ্যেই রাস্তায় অবস্থান নেয়া ছাত্রদের লক্ষ্য করে ছোড়া পুলিশের গুলি এসে লাগে মোমিনুলের পিঠে। তিনি প্রথমে বুঝতেও পারেননি গুলি তার শরীরের পেছন দিয়ে ঢুকে পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিন্ন করে দিয়েছে। গুলি লাগার কিছুক্ষণ পর তিনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। এরপর তাকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যান। বর্তমানে তিনি হাসপাতালটির ৪র্থ তলার পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারে রয়েছেন। তার পেটে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। হাসপাতালে মোমিনুলের দেখভালের দায়িত্বে থাকা মামা আব্দুর রহিম বলেন, আমার ভাগনে কখনোই কোনো আন্দোলনে ছিল না। সে ভার্সিটির ক্লাস বাদে তেমন একটা বাইরে আড্ডাও দেয় না। বাবা দেশের বাইরে থাকায় মাকে নিয়ে বেশির ভাগ সময় বাসাতেই কাটায়। ওইদিনও মোমিনুল বাসায় ছিল। বিকালে পাউরুটি কিনতে বাসা থেকে বের হয়েছিল। বাসার সামনের দোকান বন্ধ থাকায় ও রাস্তার উল্টো পাশে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই তার গায়ে গুলি লাগে। গুলিতে ওর খাদ্যনালী, নাড়ি, পায়খানার রাস্তা ছিদ্র হয়ে গেছে। একাধিকবার তার অপারেশন করা হয়েছে। অবস্থা খুবই খারাপ। গত ১৯শে জুলাই মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিং এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন দিনমজুর মো. হাবিব। তিনিও চিকিৎসা নিচ্ছেন সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে। হাবিব বলেন, তিনি ঘটনার দিন মজুরি নিতে চান মিয়া হাউজিং এলাকায় গিয়েছিলেন। এর মধ্যেই পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। ওই সময় পুলিশের ছোড়া গুলি তার পেটে ও পিঠে এসে লাগে। মোট ২১২টি ছররা গুলি তার শরীরে লেগেছে। একই দিনে মো. নীরব নামে এক রিকশাচালকও মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যান এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। তিনিও চিকিৎসা নিচ্ছেন একই হাসপাতালে। নীরব জানান, ওইদিন শুক্রবার ছিল। জুম্মার পরে তিনি রিকশা নিয়ে মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যান থেকে তিন রাস্তার দিকে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যেই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। হঠাৎ করেই পুলিশ গুলি শুরু করে। সেই গুলি তার শরীরের বিভিন্ন অংশে এসে লাগে।হাসপাতাল সূত্র জানায়, সরকারি শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংঘর্ষে আহত ৫১৮ জন চিকিৎসা নেন। শুধুমাত্র গত ১৯শে ও ২০শে জুলাই হাসপাতালটিতে ৪৭২ জন গুলিবিদ্ধ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। বর্তমানে হাসপাতালটির ৪২০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন ২০ জন। ও পোস্ট অপারেটিভের ১২টি বেডের ৮টিতেই আছে গুলি লাগা রোগী। কারও পেটে, কারও বুকে, আবার কেউ পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছেন। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক শফিউর রহমান বলেন, এই পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালের মর্গে ১৩টি গুলিবিদ্ধ লাশ আসে। এ ছাড়া পাঁচ শতাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। তিনি বলেন, কয়েকদিন পরিস্থিতি খুব খারাপ ছিল। রোগী সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে।