নিজস্ব প্রতিনিধি: হাসপাতালের বেডে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে শুয়ে আছেন মো. শাহীন ইসলাম। ডান হাতের আঙ্গুলে চেতনা নেই। হাতে ও পায়ে লেগেছে অসংখ্য ছররা গুলি। শাহীনের নানা বীর মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের এই শিক্ষার্থী গত ১৯শে জুলাই শুক্রবার নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকায় হঠাৎ শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। শাহীন বলেন, আমি লুকিয়ে একটা গলির মুখে অবস্থান নেই। কিছু সময় পর পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মাঝামাঝি পড়ে যাই। দৌড়ে পালানোর সময় পুলিশের গুলি এসে লাগে।ছেলেটা আর কলম ধরতে পারবে কিনা- জানি না...এ কথা বলেই কান্না জুড়ে দেন শাহীনের মা। অঝোরে ঝরতে থাকে চোখের পানি।তার এক্সরে রিপোর্টে দেখা যায়, হাতে ও পায়ের হাড়ে লেগেছে অসংখ্য ছররা গুলি। সব গুলি বের করা সম্ভব হলেও হাতের কবজির দুটি ছররা গুলি বের করা যায়নি। ব্যথায় ঠিকমতো নড়াচড়াও করতে পারছেন না শাহীন। চোখের কোণে পানি জমে যায় তার। এরপর বলেন, আমার ভবিষ্যৎটা নষ্ট হয়ে গেল।জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), এই হাসপাতালটি পঙ্গু হাসপাতাল নামেই পরিচিত। সেখানে শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলিবিদ্ধ হয়ে আর্তনাদ করছেন রোগীরা। কারও কারও কেটে ফেলা হয়েছে পা। পঙ্গুত্ববরণের শঙ্কা নিয়ে নিটোর-এ অসহায় আর্তনাদ করছেন শতাধিক রোগী। স্বজনদের চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ। হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে শুধুই সংঘর্ষে আহতরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেখানে কান পাতা দায়। কেউ ব্যথায় চিৎকার করে উঠছেন। কেউ অঝোরে কাঁদছেন। চারদিকে শুধুই ক্ষত-বিক্ষত রোগী। হাসপাতালটির তথ্যানুযায়ী এখানে মোট আহত রোগী এসেছেন ২৭২ জন, ছাড়পত্র নিয়ে চলে গেছেন ১৯৬ জন। যাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ রোগী ২৪৫ জন। ছয় জনের ইতিমধ্যে অঙ্গহানি হয়েছে। এই সংখ্যা বাড়তে পারে আরও। আর একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ধবধবে সাদা বিছানার চাদর। তাতে লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্তের ছাপ। ব্যান্ডেজ চুইয়ে রক্ত বের হচ্ছে। নাদিম হোসেন, বয়স সবে ১৬ বছর। রিকশাচালক বাবা বিল্লাল হোসেন ছেলেকে নিয়ে পড়েছেন মহাবিপদে। গত মঙ্গলবার তার বাঁ পা কেটে ফেলা হয়। তার বাবা অশ্রুসজল চোখে বলেন, ডাক্তার বলে ছেলেকে বাঁচাতে হলে পা কেটে ফেলতে হবে। নিজের ছেলের পা কাটার জন্য যখন বলি তখন কলিজা ফাইট্টা যায়। আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য ম্যালা টাকার দরকার। সরকারি হাসপাতাল হইলেও ওষুধপাতি, খাওয়া-দাওয়াতে ম্যালা টাকা লাগে। সামনে চিকিৎসা করাইতে পারমু কিনা সেই চিন্তায় আছি।এ সময় পাশ থেকে ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে নাদিম। তার মা বলেন, আমরা থাকি কাঁচপুরে। ছেলেটা চিটাগাং রোডে একটা গার্মেন্টে কাজ করতো। শনিবার রাত ১১টার দিকে বাড়ি আসার সময় বাম পায়ে গুলি লাগে। এরপর লোকজন একটা হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমরা ফোন পাওয়ার পর সেখানে যাই। এরপর সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। একদিন রাখার পর আনি পঙ্গুতে। কাঁদতে কাঁদতে নাদিমের মা বলেন, আমার ছোট্ট ছেলেটা পঙ্গু হইয়া গেল বাবা।১৫/১৬ বছরের বাবাহারা রাকিব হাসানও হারিয়েছে পা। বড় ছেলের পা নেই এ যেন মানতেই পারছেন না তার মা। রাজধানীর রায়ের বাজারে থাকেন তারা। অভাবের সংসারে আয়ের পথ খুঁজতে একটি সেলুনে কাজ শিখতো রাকিব। ২০শে জুলাই শনিবার কাজ থেকে আসার সময় বাঁ পায়ে গুলি লাগে। সেখানেই লুটিয়ে পরে রাকিব। এরপর গত সোমবার অপারেশন করে কাটা হয় পা। ব্যথায় কেঁদে কেঁদে উঠছেন সদ্য পা কেটে ফেলা মো. আরাফাত হোসেন। বাঁ-পা হারিয়ে বাকরুদ্ধ। গাড়িচালক আরাফাতের ছোট্ট সংসারে সাত বছর বয়সের একটি ছেলে রয়েছে। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। উত্তরার এক বাসিন্দার ব্যক্তিগত গাড়ি চালান। কাটা পায়ে প্রচণ্ড ব্যথায় বারবার কুঁকড়ে উঠতে দেখা যায় তাকে। পায়ে একটু প্রশান্তির জন্য দিয়ে রেখেছেন ছোট খাঁচা ফ্যান। তিনি বলেন, ডিউটি শেষ করে বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে বাড়ি ফিরছিলাম। ১৯শে জুলাই শুক্রবার বাসায় যাবার জন্য রাস্তা পার হচ্ছিলাম। তখন কিছুটা শান্ত পরিবেশ। হঠাৎ গুলি শুরু হয়। জীবন বাঁচানোর জন্য দৌড় দেই। বিদ্যুতের মতো বাঁ পায়ে কিছু একটা জোরে এসে লাগে। এরপর আমি আর কিছু বলতে পারি না।তিনি বলেন, জ্ঞান ফিরে দেখি উত্তরার একটি হাসপাতালে। এরপর ডাক্তার পঙ্গুতে পাঠাইলো। জীবন বাঁচানোর জন্য পা কেটে ফেলা লাগলো। এই কথা বলার সঙ্গেই কেঁদে উঠেন তিনি। পায়ের দিকে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। পায়ের ব্যথায় নড়তে চড়তে ভীষণ কষ্ট তার। সামান্য একটু বাঁকা হওয়ার জন্যও কয়েক মিনিট সময় ও অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে। আরাফাত বলেন, আমার ছেলেটার বয়স সাত বছর। আমি পঙ্গু। সংসার চলবে কেমনে? আমার ছেলেটার কী হবে?দুই ছেলেমেয়ে ফরহাদ হোসেনের। বড় ছেলের বয়স দুই বছর আর মেয়ের বয়স মাত্র দুই মাস। স্ত্রীর গর্ভকালীন জটিলতা এখনো পুরোপুরি কেটে ওঠেনি। এরই মধ্যে পরিবারটির ওপর নেমে এসেছে মহাবিপদ। ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান ফরহাদ। ১৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে বাজার করতে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হন। ডান পা থেকে গুলি বের করা হলেও শঙ্কা কাটেনি। ইনফেকশন হয়ে গেছে পায়ে। পা শুকিয়ে গেছে আর পায়ের পেছন দিকে ধরেছে ‘পচন’। তিনি বলেন, আমি পঙ্গু হইয়া যাই কিনা এই ভয়ে আছি। আমার দুইটা ছেলে মেয়ে তাদের কী হবে? এমনিতেই অভাবের সংসার তার উপর এত টাকার চাপ। ধারদেনা করে চিকিৎসা করা লাগছে। ডাক্তার বলছে, ঘা না শুকাইলে অপারেশন করা যাবে না। আমার পা কাইট্টাও ফেলা লাগতে পারে। আমি চালাই ভ্যান, পা কেটে ফেললে... বলেই কেঁদে ফেলেন তিনি। ডান হাত ও ডান পায়ে গুলির ক্ষত নিয়ে হাসপাতালের বেডে মো. সোলায়মান। বয়স মাত্র ১৪। শরীরের একাংশের ব্যথায় কাবু। শরীর এতটাই দুর্বল যে, চোখ মেলে তাকাতে পারে না। সোলায়মান পেটের দায়ে কাজ করে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় মোজার কারখানায়। সোলায়মানের সঙ্গে থাকা তার ভাই জানান, ১৯শে জুলাই শুক্রবার সংঘর্ষের কারণে কাজে যায়নি সে। বাড়ির গলিতে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল। এমন সময় গোলাগুলি শুরু হয়। হঠাৎ এসে ছররা গুলি লাগে। এরপর থেকে একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে আনা হয় এখানে। ভাই বলে, আমগো পেটই চলে না চিকিৎসা করার টাকা পামু কই? খাইয়া না খাইয়া পইড়া আছি। তিতুমীর কলেজের প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী সালমান হোসেন। মেরুল বাড্ডাতে থাকেন পরিবারসহ। তিনি বলেন, আমি নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়ির দিকে যাচ্ছি এ সময় আমার এক হাতে জায়নামাজ আরেক হাতে মোবাইল। হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলো। কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার পাশে একটা বাচ্চা ছেলের গুলি লাগে। এরপর আমার উরুতে গুলি লাগলো। গুলির জন্য পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। গলগলিয়ে রক্ত পড়তেছে। আমার বন্ধুরা আমাকে ধরে সিএনজিতে করে পাশের একটা হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর আনা হয় এখানে।চিকিৎসক জানিয়েছেন, ক্ষত না শুকানো পর্যন্ত অপারেশন করা যাবে না। সালমান বলেন, আমার আগস্টের শেষে ফাইনাল পরীক্ষা। আমি কোনোদিন আর সুস্থ হতে পারবো কিনা কে জানে!কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মা বলেন, আন্দোলনের কারণে বাইরে যেতে দিতাম না। আর নামাজে গেল এজন্য কিছুই বলি নাই।দুই হাত ভেঙেছে মিরপুর পল্লবী জোনের ট্রাফিক পুলিশ মো. আরফান আলীর। সেইসঙ্গে ফেটেছে মাথা। এই পুলিশ সদস্য ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, মিরপুর-১০ নম্বরে আমার ডিউটি ছিল। অতর্কিত আমার ওপর হামলা হয়। কয়েকজন মিলে আমারে পিটাইতে থাকে। জীবন বাঁচানোর জন্য দুই হাত মাথায় দিয়ে রাখি। আমারে পিটানোর পর ম্যানহোলের ভিতর ঢুকাইতে যায়। এ সময় অন্য পুলিশ সদস্যরা এসে আমারে বাঁচায়।হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীও রয়েছেন। তারা ভীত অবস্থায় সময় পার করছেন। রামপুরা এলাকায় আন্দোলনের সময় আহত হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, শনিবার (২০শে জুলাই) আমরা বন্ধুরা মিলে মিছিল নিয়ে রামপুরা সড়ক দখল করে রেখেছিলাম। আমরা বন্ধুরা সবাই একত্রেই ছিলাম। কিন্তু আমাদের গ্রুপের মাঝে একটা টিয়ারশেল বা সাউন্ড গ্রেনেড এসে পড়ে। আমি ধোঁয়ার কারণে কিছু দেখতে পারছিলাম না। সড়কের একটি গলির দিকে পালানোর চেষ্টা করছিলাম। এ সময় গলির মুখে পুলিশ বা বিজিবি ছিল। তাদের ছোড়া গুলিতে আমার বাঁ পায়ে ও তলপেটে এসে লাগে। আমি সেখানেই লুটিয়ে পড়ি। ধোঁয়া যখন শেষ হয় তখন দেখি আমার একদিকে পুলিশ ও বিজিবি। এরপর আমি আর কিছু বলতে পারি না। আমার বন্ধুরা আমাকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমার বাবা-মা এখানে নিয়ে আসেন। ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা বৃহস্পতিবার (১৮ই জুলাই) নীলক্ষেতে অবস্থান নিয়েছিলাম। নিউমার্কেট এক নম্বর সড়কে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। এ সময় একটা টিয়ারশেলের কারণে কাবু হয়ে পড়ি। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমি একটু পিছিয়ে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। নড়ার শক্তি ছিল না। এরপর কিছু সময় পর পুলিশ ধাওয়া দেয়। অন্যরা পালাতে পারলেও আমার হাতে ও পিঠে ছররা গুলি লাগে। আমার বন্ধুরা আমাকে টেনে নিয়ে যায়। রিকশায় ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাওয়ার সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এখন আমার হাত নিয়ে টেনশনে আছি। রোববার ডাক্তার দেখে সিদ্ধান্ত জানাবেন। এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, আমার বাবা অসুস্থ। বাবার পেনশনের টাকা আর মায়ের সেলাইয়ের কাজে সংসার চলে। আমি টিউশনি করে নিজের খরচ চালাই। আমার ছোট বোন এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। আমি এখন পরিবারের সম্বল না হয়ে বোঝা হয়ে পড়লাম।সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, রোগীদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছি। আমাদের সামগ্রিক চিকিৎসা সামগ্রীর পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ এ্যাড. নজরুল ইসলাম । ২০২০ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | দৈনিক ভোরের খবর,খন্দকার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান। অফিসঃ ১৫০ নাহার ম্যানসন (৫ম তলা) মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকা,ঢাকা -১০০০। বার্তাকক্ষ-+৮৮০১৭৪৫-৩৫৪২৭৭