শহীদুল ইসলাম শহীদ,সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধিঃ জামাল হোসেনের (৫৭) বাড়ি গাইবান্ধার রামভদ্র গ্রামে। তিনি দিনমজুরের কাজ করতেন। দৈনিক যে মজুরি পেতেন, তা দিয়ে সংসার চলতো না। ধারদেনা করে ১৯৮৪ সালে ২০টি হাঁস কিনেন। সেই ২০টি হাঁস দিয়ে যাত্রা শুরু। পর্যায়ক্রমে মাছচাষ, মুরগি ও গরুর খামার গড়ে তোলেন। পাশাপাশি হার্ডওয়ার ও পোল্ট্রি খাদ্যের ব্যবসাও করছেন। কিনেছেন প্রায় আট-নয় বিঘা জমি। ছয়জন ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। মেধা ও পরিশ্রমে জীবনের চাকা পাল্টে দিয়েছেন। মাত্র ৩৫ বছরের ব্যবধানে দিনমজুর থেকে তিনি এখন কোটিপতি।
জামাল হোসেন জানালেন, বর্তমানে তাঁর এক একর ৫২ শতক জমিতে রয়েছে পুকুর। সেই পুকুরে মাছ চাষ করছেন। পুকুরের ওপরে মুরগির সেড। সেডের পাশেই গরুর খামার। খামারে রয়েছে এক হাজার ২০০ মুরগি। প্রতিদিন ডিম পাচ্ছেন এক হাজার ১০০টি। ডিম বিক্রি করে মাসিক প্রায় ৫০ হাজার টাকা, মাছ বিক্রি করে সাড়ে ১২ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। আয় হচ্ছে ব্যবসা থেকেও। তিনি বলেন, কথায় বলে পরিশ্রমে ধন আনে। আমি তা প্রমাণ করেছি। ভবিষ্যতে একটি মডেল খামার গড়ে তুলবো। যা দেখে খামার করতে মানুষ উদ্বুদ্ধ হবে।
জামাল হোসেনের মত খামার করে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এখন স্বাবলম্বী। উপজেলায় গরুর খামার করে ও পোল্ট্রি শিল্পের বিপ্লব ঘটেছে। ঘরে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরুর খামার গড়ে উঠেছে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সুত্র জানায়, পনেরটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত সুন্দরগঞ্জ উপজেলা। লোক সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। এরমধ্যে বেশিরভাগ মানুষ গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করেন। তবে উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে ২১০টি গরুর খামার, ১৫০টি ছাগলের খামার, ৬০টি ভেড়ার খামার, ৩৮টি হাঁসের খামার ও ২৩৯টি মুরগির খামার রয়েছে। খামারকে কেন্দ্র করে উপজেলায় প্রায় ২৫টি ডিমের পাইকারি আড়ত, প্রায় ২৫০টি গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগির খাদ্য বিক্রির দোকান গড়ে উঠেছে। জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে এ উপজেলায় হাঁস মুরগির খামারের সংখ্যা বেশি। এজন্য সুন্দরগঞ্জ উপজেলাকে পোল্ট্রি জোন হিসাবে ঘোষণা করেছে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দুরে রামভদ্র গ্রাম। গ্রামটি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের অন্তর্গত। শনিবার (১৮ নভেম্বর) সরেজমিনে দেখা গেছে, ঘরে ঘরে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনের চিত্র। কেউ বসতভিটায় গড়ে তোলা খামারে গরুর পরিচর্যা করছেন, কেউ মুরগির খামারে ডিম সংগ্রহ করছেন। ছোট ছোট বাজারে ডিমের আড়াতে বেচাকেনা চলছে। বেচাকেনা চলছে পোল্ট্রি খাদ্য। কয়েকজন খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাঁদের সাফল্যের গল্প।
রামভদ্র গ্রামের আবদুর রহিম (৪০)। তিনি পোশাসক কারখানায় চাকরি করতেন। মাসিক ছয় থেকে সাত হাজার টাকা বেতন পেতেন। তা দিয়ে সংসার চলতো না। ১৫ বছর আগে চাকরি ছেড়ে দেন। বাড়িতে এসে গরু পালন শুরু করেন। তার খামারে বর্তমানে আটটি গরু রয়েছে। দুধ বিক্রি করে মাসিক আয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। পাশাপাশি তিনি ইনকিউবিটরে হাঁস-মুরগির বাচচা ফুটান। এখান থেকেও তার আয় হয়। আবদুর রহিম বললেন, চাকরিতে হিসাবের পয়সা। তা দিয়ে সংসার চলে না। পরিশ্রম ও বুদ্দি খাটিয়ে নিজে ব্যবসা করলে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, তার প্রমাণ আমি নিজে। আগে পোশাক কারখানায় বেতন নিতাম। এখন আমি দুই তিনজনকে বেতন দেই।
রামভদ্র রাজবাড়ি গ্রামের কলেজ ছাত্র আবু তাহের। তিনি ছাইতানতলার একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়েন। বাবা জিনাত আলী বর্গাচাষী। জমি থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে পাঁচজনের সংসারই চলে না। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি ছাগল পালন করেন। তার খামারে বর্তমানে ৬৪টি ছাগল রয়েছে।
আবু তাহের বলেন, হাট থেকে ছোট ছাগল কিনি। তা লালন পালন করে বড় করে বিক্রি করে। প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা লাভ হয়। লেখাপড়ার ফাঁকে এ কাজ করে নিজের খরচ চালাচ্ছি। পাশাপাশি সংসারেও যোগান দিচ্ছি।