উপজেলা প্রতিনিধিঃ অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের কারণে দারিদ্র দুরীকরনে নেওয়া দেশে একমাত্র গাইবান্ধায় একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১৮ সালে সাড়ে পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ওই সালের এপ্রিলে প্রথমে প্রায় ৪১ কোটি ৭৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০২১ সালের জুলাই মাসে আরও ৯ কোটি ১৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। মোট বরাদ্দ ৫০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।এর মধ্যে প্রশিক্ষণ বাবদ ১৬ কোটি ২০ লাখ ৮৮ হাজার, ঋণ বাবদ ২৬ কোটি টাকা এবং ব্যবস্থাপনা বেতন ভাতা বাবদ ৮ কোটি ৭০ লাখ ১২ হাজার টাকা। ১৫ থেকে একমাস ব্যাপী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ১৮ হাজার ৬০০ জন দরিদ্র নারী পুরুষকে। প্রতিজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তকে ১৯ হাজার ৫০ টাকা করে দেওয়ার কথা। প্রতিজনকে ২০ হাজার করে মোট ১৩ হাজার জনকে ঋণ দেওয়া হয়।সরেজমিনে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। প্রকল্পের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রশিক্ষণাথীদের তালিকা যাচাই করে দেখা গেছে, তালিকায় নাম আছে কিন্তু অর্ধেক নারী-পুরুষ প্রশিক্ষণ পাননি।এমন অন্তত ৫০ জনের সঙ্গে কথা বলে সত্যতা পাওয়া গেছে। গাইবান্ধা সদর উপজেলার জগতরায় গ্রামের সুমি বেগম (৩৬) বলেন, প্রশিক্ষণ নেওয়া দূরের কথা, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। একই মন্তব্য করেন সাদুল্লাপুর উপজেলার বড় জামালপুর গ্রামের সেলি বেগম (৪১)।এমনকি প্রশিক্ষণ নিতে ঘুষ গ্রহণ ও ভাতার টাকা কেটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সদর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের ছবি আক্তার (৩৫)বলেন, প্রশিক্ষণের জন্য আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়া হয়। একই অভিযোগ করেন পার্শ্ববর্তী ভগবানপুর গ্রামের রুমি বেগম (৩০), কল্পনা রানী (৪০) ও রাশেদা বেগম (৩৮)।প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ভাতার টাকাও কেটে নেওয়া হয়েছে অসংখ্য ও সুবিধাভোগির। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর গ্রামের ফরিদুল ইসলাম (৪৫) বলেন, আমি একমাসের প্রশিক্ষণ নেই। ভাতা পায় ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। এরমধ্যে আমাকে মাত্র ২ হাজার ৫০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমার কাছ থেকে চেকে সই নেয়। একই অভিযোগ করেন একই উপজেলার সিংজানি গ্রামের আবদুল হালিম (৪৪) ও নুরুল আমিনসহ (৫০) অনেকে।২৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। এক বছরের মধ্যে দিনের টাকা পরিষদের কথা। এখন পর্যন্ত অর্থাৎ গত তিন বছর অর্ধেক টাকায় আদায় হয়নি।এদিকে দারিদ্র দূরীকরণে ঋণ বিতরণ করা হলেও সেই ঋণ কোন কাজে লাগেনি। ঋণ গৃহীতারা পাচঁ থেকে ছয়মাস ব্যবসা করেন। এরপর বাজারজাত সমস্যা ও প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ঋণ গৃহীতাদের অধিকাংশই এখন হাত গুটিয়ে বসে আছেন।সাগাটা উপজেলার শিমুলতাইর গ্রামের শাহীন মিয়া (৩৭) বলেন, আমি বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি। কাজের জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ২০ হাজার টাকা ঋণ নেই। ঋণ নিতেও এক থেকে দুই হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। তারপর দোকান দেই। কিছুদিন ভালোভাবে ব্যবসা করি। এরপর ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় বর্তমানে বেকার হয়ে আছি। ফুলছড়ি উপজেলার উত্তরকাঠুর গ্রামের সাইদা বেগম (২৮) বলেন, দর্জি কাজের জন্য ২০ হাজার টাকা ঋণ নেই। মেশিনে নারীদের পেটিকোট ব্লাউজ তৈরি করি। তৈরি করা মালামাল স্থানে বাজারে বিক্রি করি। কয়েক মাস ব্যবসা ভালো চলে। কিন্তু বর্তমানে বাজারে চাহিদা না থাকায় এবং মূলধনের অভাবে ব্যবসা বন্ধ আছে। তিনি আরও বলেন, ঋণের টাকার জন্য অফিস থেকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে। আদায়কারীরা এখন টাকার জন্য বাড়িতে আসছে। ঋণ নিয়ে লাভ তো দূরের কথা, এখন বিপদে আছি।২০ হাজার টাকা ঋণ নেন একই গ্রামের রমনা আক্তার (৩০)। তিনি বলেন, ঋণের টাকায় সেলাই মেশিন কিনি। কিছুদিন ব্যবসা ভালো চলে। এরপর মেশিনটি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু টাকার অভাবে সংস্কার করতে পারিনি। মেশিন অকেজো ব্যবসা বন্ধ। এখন হাতে কোন কাজ নাই। উপরন্ত ঋণের টাকার জন্য অফিস থেকে চাপ দিচ্ছে। ঋণ নিয়ে আমরা বিপাকে পড়েছি।চলতি বছরের জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের উদ্দেশ্য কার্যত সফল হয়নি।সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে ভেজতে গেছে।এদিকে ঋণের পরিমাণ কম, প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও অনেককে ঋণ না দেওয়া এবং সুবিধাভোগি বাছাই শতভাগ হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। সাদুল্লাপুর উপজেলার পাটনিপাড়া গ্রামের আল্পনা রানী (৩০) বলেন, আমরা আগে থেকেই বাশ দিয়ে ঝুড়ি চালুন কুলা তৈরির কাজ করতাম। এই কাজের ওপর আমাদের ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ১৫ দিন প্রশিক্ষণের ভাতা আড়াই হাজার টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদেরকে ঋণ দেওয়া হয়নি। এখন বাশের দাম বেশি। টাকার অভাবে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী জিনিসপত্র তৈরি করতে পারছি না। একই গ্রামের গৌর চন্দ্র (৫৫) বলেন, আমরা বাপ-দাদার আমল থেকেই বাশের কাজ করি। আমাদেরকে কেবল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের লাভ কি হলো। আমরা তো এই কাজ আগে থেকেই জানি। ঋণ পেলে আমাদের কাজে লাগতো। কিন্তু বার বার আবেদন জানিয়েও আমরা ঋণ পাচ্ছি না।এসব বিষয়ে গাইবান্ধা সমম্বিত পল্লী দারিদ্র দুরীকরন কর্মসুচির প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবদুস সবুর বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জেলার প্রায় ১৬ হাজার মানুষের দারিদ্রতা দুর হবে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও ঋণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণ দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে ঋণের পরিমাণ বাড়ানো চিন্তা চলছে। পাটনিপাড়া গ্রামে ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সুবিধাভোগিদের তালিকায় অবস্থাপন্ন কিছু লোকের নাম আসতে পারে। তবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও তাদের ঋণ দেওয়া হবে না।