ঢাকামঙ্গলবার , ৮ আগস্ট ২০২৩
আজকের সর্বশেষ খবর

গৃহহীন মানুষদের জীবন বদলে দিয়েছে বেড়ার আশ্রয়ন প্রকল্প


আগস্ট ৮, ২০২৩ ২:৫২ অপরাহ্ণ
Link Copied!

বেড়া(পাবনা)প্রতিনিধিঃ কিছুদিন আগেও যাদের ছিল না কোনো মাথা গোঁজার ঠাঁই, তারা এখন রঙিন টিন আর আধাপাকা বাড়িতে বসবাস করছেন। মুজিববর্ষ উপলক্ষে পাবনার বেড়া উপজেলার ভাসমান, ভূমিহীন ও গৃহহীন ৮৭৪টি পরিবার জায়গাসহ বাড়ি পেয়েছে। এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর জীবন বদলে দিয়েছে ভাসমান, ভূমিহীন, গৃহহীন ও যমুনার পাড়ভাঙ্গা মানুষদের। একটা সময় অন্যের জমিতে দয়া-দাক্ষিণায় থাকা সেই মানুষ আজ আত্মনির্ভরশীল। কৃষি থেকে শুরু করে নানা কাজের মাধ্যমে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তারা।
উপজেলার মাসুমদিয়াা ইউনিয়নের ফকিরকান্দি আশ্রয়ন প্রকল্প সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে বিদ্যুৎ। প্রতি পাঁচটি বাড়ির জন্য একটি করে পানির কল (টিউবয়েল)। তাদের অনেকের ঘরেই চখে পড়ে টেলিভিশন। ফ্রিজও আছে দুয়েকটি বাড়িতে। সামনে বা পেছনে ফাঁকা জায়গায় অনেকেই তৈরি করেছেন গোয়াল ঘর। গরু ছাগল বর্গা নিয়ে লালন পালন করছেন তারা। আঙিনায় কেউ লাগিয়েছেন নানা ধরনের সবজি। বাড়ির বারান্দায় কেউ দিয়েছেন ছোট্্র দোকান। ঘরে সেলাই মেশিনে কাজও করছেন কেউ কেউ। বাইরে নানা ধরনের কাজের পাশাপাশি এগুলো তাদের বাড়তি আয়ের পথ খুলে দিয়েছে, যা তাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে পরিপাটি জীবনের।
রুপপুর আশ্রয়ণের বাসিন্দা স্বামী পরিত্যক্ত লাইলি খাতুন (৩৫)। ৭৫ বয়সের বৃদ্ধা মা আলেয়া খাতুন ও ৭ বছরের ছেলে আসগর আলীকে নিয়ে তার সংসার। নদী তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। বিয়ের পর নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে লাইলি। সেই স্বপ্ন আর ধরা দেয়নি তার জীবনে। ছোট ছেলে ও তাকে ছেড়ে চলে যান স্বামী। বাবাহীন সংসারে ভাইদের আশ্রয়ে ছিলেন। লাইলি বলেন, ভাইয়েরাও দিন এনে দিন খায়। খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। চোখে অন্ধকার দেখতাম। প্রধানমন্ত্রী আমাদের পাকা ঘর দিয়েছেন, স্থায়ী ঠিকানা দিয়েছেন। এখন নিজের পরিচয় পেয়েছি। মা ও ছেলেকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছি। লাইলির ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল রঙিন টেলিভিশন। নিজে পালন করা ছাগল বিক্রি করে ছেলে ও মায়ের জন্য এটি কিনে দিয়েছেন। সেলাই মেশিন দিয়ে কাঁথা তৈরির কাজ করেন। তিনি জানান এখন মা ছেলেকে নিয়ে ভাল আছি।
লাইলির মা আলেয়া খাতুন বলেন, এক সময় আমাদের বাড়ি, ফসলী জমি ও গোয়ালে গরু ছিল। প্রায় ৩০ বছর আগে যমুনার প্রচন্ড ভাঙনে সবকিছু হারিয়েছিলাম। খাসজমির ওপর ছাপরা ঘর তুলে থাকতাম। ১৬ বছর আগে স্বামী মারা যান। এরপর মেয়েকেও তার স্বামী ছেড়ে দেয়। খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। ছেলেরা দেখত। কিন্তু তাদেরও সামর্থ্য নেই।
কৃষি শ্রমিক রফিকুল ইসলাম অন্যের জমিতে মজুরের কাজ করেন। সেই কাজ না থাকলে নাকালিয়া বাজার থেকে মাছ কিনে এনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করেন। আশ্রয়ণের ঘর পেয়েছেন তিনি ও তার স্ত্রী আয়েশা খাতুন। আগে এখানেই খাস জায়গায় ছাপরা ঘর ছিল তাদের। এখন পেয়েছেন পাকা ঘর। তাদের ঘরের সামনে যেতেই চোখে পড়ে বাজার থেকে কিনে আনা মাছ বিক্রি করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। পাশে দাঁড়িয়েছিল স্ত্রী। তারা বলেন, আগে ছাপরা ঘর ছিল। এখন পাকা বাড়ি পেয়েছি। বাড়ি সামনে দেয়া গোয়াল ঘর দেখিয়ে বলেন, এনজিও’র ঋণ দিয়ে গরু কিনে মোটাতাজা করছি। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করার স্বপ্ন এখন তাদের চোখে।
জাতশাখিনী ইউনিয়নের আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা স্বামী হারা নাসিমা বেগমের সাথে কথা হচ্ছিল এ প্রতিবেদকের। তার একটি মেয়ে। সে প্রতিবন্ধি। এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে কাজ করতেন। রাত হলে প্রতিবন্ধি মেয়েকে নিয়ে ঘুমাতেন বাধের ঝুপড়ি ঘরে। বাবা সেকেল উদ্দিন মারা যাওয়ার পর নিদারুন কষ্টে জীবন যাপন করছিলেন। তিনি জায়গাসহ বাড়ি পেয়েছেন জাতশাখিনী আশ্রয়ণ প্রকল্পে। পাকা ঘরের সামনের আঙিনায় শাক-সবজি চাষ করে মা-মেয়ে ভাল আছেন।
উপহারের ঘরের বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী হাসনা বেগম। নিজের কিংবা স্বামীর ভিটেমাটি না থাকায় জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়ে দিয়েছেন ভাড়া কিংবা অন্যের জায়গায় ঘর করে। জীবনসায়াহেৃ এসে পেয়েছেন নিজের নামে স্থায়ী ঠিকানা। মুজিববর্ষ উপলক্ষে উপহারের ঘর পেয়ে তার চোখে আনন্দাশ্রæ। তিনি বলেন,‘সুন্দর ঘর, শান্তির ঘর’। এই ঘর জীবনে দিতে হারতাম না। প্রধানমন্ত্রী এই ঘর দিছে। আল্লায় হেরে ভলো রাহুক।
হাসিমাখা মুখে ৬৭ বছরের জমিলা খাতুন বলেন, ‘মানুষের গোয়াল ঘরে, রান্নাঘরে থেকেছি। সারের বস্তার কাগজের ছাউনি দিয়ে কোনভাবে মাথা গুঁজেছি। চরপেঁচাকোলার বাসিন্দা জমিলা বলেন, ‘ এক সময় বাপের সম্পদ ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাবা মোকসেদ আলী মারা যায়। এরপর চাচারা জমি দখল করে উচ্ছেদ করে দিয়েছে আমাদের তিন ভাইবোনকে। প্রধানমন্ত্রী পাশে দাঁড়িয়েছে, মাথা গোঁজার জন্য ঘর পেয়েছি, আর কিছুই চাই না।
সরেজমিনে একাধিক আশ্রয়ণে গিয়ে দেখা যায়, ইতিমধ্যে জায়গাসহ বাড়ি পাওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের বসতিরা বাস করছেন রঙিন টিন আর পাকা দেয়ালের আধাপাকা বাড়িতে। সেখানেই করছেন শাক-সবজির আবাদ। কেউবা হাঁস-মুরগি, ছাগল-গরু পালন করছেন। সন্তানদের পাঠাচ্ছেন স্কুলে। সুবিধাবঞ্চিত এসব অসহায় মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর এই উপহার তাদের ভেতরে নতুন স্বপ্ন বোনার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। খোলা আকাশের নিচে থাকা, বৃষ্টিতে ভেঁজা ও রোদে পোড়া গৃহহীন মানুষগুলোর স্বপ্নও পুড়ে অঙ্গার হতে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর সেই মানুষগুলোর নিঃশেষ হওয়া স্বপ্ন ফের ফিরিয়ে এনেছে। মাথার ওপর ছাদ সেই সব মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে শুরু করেছে।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাঃ সবুর আলী বলেন, জীবনে যত মানবিক কাজ করেছি এটা হলো তার মধ্যে অন্যতম। এই কাজ করার অনুভূতি আসলে একেবারেই ব্যতিক্রম। ছিন্নমূল ভূমিহীন মানুষদের একটি ঘর দিতে পেরে ভাল লাগছে। তাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করছি, তা সত্যি অভাবনীয়। এখানকার মানুষের অনুভূতি, তাদের আনন্দ আমাদের পুলকিত করে। তিনি বলেন, ভূমিহীন-গৃহহীনরা আজ নিজেদের ঠিকানা পেয়েছেন। জীবনকে বদলে দিতে পেরেছেন। এক সময় রোদেপোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা মানুষগুলো আজ আত্মমর্যাদা নিয়ে নিজেদের ঘরে বসবাস করতে পারছেন।
বেড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ আরিফুল ইসলাম জানান,, উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে আশ্রয়নের মোট ৮৭৪টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে হাটুরিয়া ইউনিয়নে ৬১টি, মাসুমদিয়ায় ৬৭টি, রুপপুরে ১৭০টি, চাকলায় ২৩১টি, নতুন ভারেঙ্গায় ২৯টি, পুরান ভারেঙ্গায় ৭২টি, কৈটোলায় ৭৩টি, জাতশাখিনীতে ১৩৯টি, বেড়া পৌরসভায় ৩২টি। আশ্রয়ণেন ঘর নির্মাণে প্রয়োজন হয়েছে এক হাজার ৮৫১ দশমিক ৩১ শতাংশ ভূমি। এরমধ্যে খাস এক হাজার ১০০ শতাংশ ও ক্রয়কৃত ভূমি রয়েছে ৭৫১ দশমিক ৩১ শতাংশ।
বেড়া উপজেলার বেড়া পৌরসভা হাটুরিয়া- নাকালিয়া, মাসুমদিয়া, চাকলসহ ৯টিা ইউনিয়ন সরেজমিন ঘুরে উপকারভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখন তারা কেউ বসে নেই। সবাই কিছু না কিছু করছেন। স্বাবলম্বী হওয়ার দারুন প্রচেষ্টা আছে আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের। কেউ কেউ গরু মোটাতাজা করছেন, কেউ ছাগল পালন করছেন, আবার কেউবা তাঁত পেতে কাপড় তৈরি করছেন, কেউ দোকান দিয়েছেন। এই একটি ঘরই তাদের জীবনই বদলে দিয়েছে। সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। এক সময়ে অবহেলিত, নিঃস্ব মানুষগুলো এখন সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখছেন।
উল্লেখ্য আগামী ৯ আগষ্ট (বুধবার) সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবনার বেড়া উপজেলার চাকলা আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুফলভোগীদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলে এই উপজেলাকে ভূমি ও গৃহহীন মুক্ত ঘোষনা করবেন। এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহন করেছেন।

✅ আমাদের প্রকাশিত কোন সংবাদের বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ  বা পরামর্শ থাকলে ই-মেইল করুনঃ dailyvorerkhabor@gmail.com❌ বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।