ডা .জাকারিয়া চৌধুরীঃ ১৩ই অক্টোবর ২০১৪ সাল যেদিন অধ্যাপক পিয়াস করিম মারা গেলেন, আমি তাঁর জন্যে কাঁদিনি। পাক্কা নয়টি বছর গেলো। আটটি মৃত্যু বার্ষিকী গেল। বাংলাদেশের কোনও প্রান্তে তার স্মরনে কেউ এক দুইবার তার নামটি শ্রদ্ধাভরে উচ্চারন করেছে কি ? কোন সভায় কিংবা সেমিনারে !! টক’শো তে ? আমি ব্যাক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি তিনি সে-সময় একাই গোটা জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন। দেশে স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে – এ কথা জাতিকে বিশ্বাস করিয়েছিলেন। কেবল একটা জিনিস বিশ্বাস করিনা।
হল তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত মরে গিয়েছিলেন। আমি মনে মনে খুব চাইছিলাম, সুইস কোনও প্রতিষ্ঠান লাইক যারা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যু রহস্য উন্মোচন করেছিলেন, তাদের দিয়ে পিয়াস করিম সাহেবের একটা পুর্ন ময়না তদন্ত হোক। তার কথাবার্তা বেশিরভাগই বিএনপি’র পক্ষে যেত কিন্তু তিনি পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন না। দোষীকে দোষী বলতে দ্বিধা করতেন না। তার নৈতিক এ সততা-ই আমার কাছে তাকে অমর করে রেখেছে। তিনি বলেছিলেন সরকার এখন মধুচন্দ্রিমা ভোগ করছে। ধরাকে সরা করছে। রাজনীতির ব্যাক ফায়ার যখন সরকারের উপর ফিরে আসবে তখন সরকার বুঝবে কত ধানে কত চাল আর যায় কোথায় !! চেতনায় আঘাত বলে কথা !!! তাকে পারলে টেনে ছিড়ে ফেলার মত অবস্থা দশা তৈরী করা হল। পিয়াস করিমের মৃত্যু’র পর তার লাশ শহীদ মিনারে নিতে দেয়া হল না। যুক্তি কি ? যুক্তি হলো তিনি রাজাকারের পক্ষে কথা বলছেন। তার লাশ যেন কিছুতে-ই শহীদ মিনারে নেয়া না যায় সেখানে চেতনার লোকেরা কয়েকটা শুয়োর তুলে দিল !! সত্যিকারের শুয়োর !!! আই মিন ইট। দেশে যে শুয়োর পাওয়া যায় এটুকুও আমার জানা ছিল না। পত্রিকায় শুয়োরের ছবি দেখে আমি খুবই বিষ্মিত হই। শহীদ মিনার তো সাধারন কোন স্ট্যাচু নয়। এর ইতিহাস রক্তে কেনা।
ভাষার জন্য দুনিয়ায় কেবল বাংলাদেশীরা-ই রক্ত দিয়েছিল। তাদের স্মরনে নির্মিত এ শহীদ মিনারে শুয়োর তোলা জায়েজ হয়ে গেল, জায়েজ হলোনা পিয়াস করিমের শবে মানুষের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য একটু সুযোগ দেয়া। একদিন খুব আক্ষেপ করে আমাকে বললেন- অনেক মুল্য দিতে হবে………… অনেক রক্ত দিতে হবে। তার বলা কথা বর্নে বর্নে সত্য হয়েছে…… তার বলা কথা স্বর্নাক্ষরে লিখে রাখা উচিত ছিল। এ জাতি পিয়াস করিমদের মুল্যায়ন করতে শিখবে কত শতাব্দী পরে কে জানে !…… এ অকৃতজ্ঞ জাতি কখনো সভ্য হয়ে উঠার যোগ্য হবে কিনা এ সন্দেহ আমার প্রকট।
তো যা বলছিলাম আর কি …………… মানে যেভাবে একটা সম্পর্কের সুত্রপাত হতে পারে।
স্থানঃ প্রেসক্লাব।
স্যার, আমি আপনার সাথে এক মিনিট কথা বলতে চাই।
আগে আমাকে বাথরুমটা দেখিয়ে দাও তো।
আমরা দুজনেই হেসে ফেললাম। আমাদের পরিচয় হলো প্রেসক্লাবের পশ্চিম প্রান্তের খোলা বাথরুমের সামনে।
স্থানঃ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজা। ড্যাব ইফতার পার্টির আয়োজন করেছে। বেগম খালেদা জিয়া সেখানে থাকবেন। স্টেজ বরাবর রাস্তা ধরে কারা কারা প্রবেশ করতে পারবেন তার একটা ধারনা আমাকে দেয়া হল। আমি সেখানে ঈগলের চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছি।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পিয়াস করিম সাহেব এক প্রকার দৌড়ে আসছেন। আগ বাড়িয়ে বললাম- স্যার, দেরি করে ফেলেছেন। গতরাতে আমাদের ফোনে কথা হয়েছে। মনে হল, উনি অন্য জগতে আছেন। আমাকে চিনেছেন স্যার ?
এই, সংসদে কি আমাদের ব্যাবহারের জন্য কোন বাথরুম আছে ?
আমরা দুনিয়া কাঁপিয়ে হাসলাম। আসলে-ই তো ! আমাদের মত ছাপোষাদের কথা কি সাংসদেরা কখনো চিন্তা করেছেন ? নাকি আমরা কখনো এর আশ পাশে যেতে পারি ! সেটা-ই ত জানিনা। আমরা দু’জনে প্রায় হাত ধরাধরি করে হাঁটছি। খুঁজে খুঁজে একটা বাথরুম বের করলাম। আমাদের সেদিনের আচরন ছিল পরস্পরের প্রতি সহোদরের মত। এলেবেলে কথা বলছি। আমি বুঝিনি উনি অন্য ধ্যানেই আছেন। এরই তিনি এক ফাঁকে এদিক সেদিকে তাকিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন – আমাদেরকে অনেক অনেক মুল্য দিতে হবে। মনে রেখো, এরা মানুষ না
-আরে না না কুমিল্লায় যাওয়া হয়না বহুদিন। আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা কুমিল্লায়। চমকে উঠলাম। এটা জানা ছিল না। আমি আমার মত করে জিগেস করেছিলাম তিনি সময় পেলে কুমিল্লায় যাবেন কিনা !! চল এক সাথে একদিন কুমিল্লায় যাই।
আমি সাগ্রহে রাজি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম – কি খাবেন ?
সাদা ভাত আর ভাজি মাছ। ভাজা মরিচে বাগাড় দেয়া ডাল।
ক্ষনজন্মা সাদাসিধে মানুষ। সাদাসিধে চাওয়া, সাদা মনের মানুষ জনাব পিয়াস করিম। আজ ভোরে কেউ কিছু টের পাবার আগেই দুনিয়া ছাড়লেন। আমাদের দেশের নেতারা লাশ কাউন্ট করে বলে এ সরকারের আমলে এত জন নিরিহ লোক আর এতজন দলীয় নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। ইনি এগুলো পছন্দ করতেন না। তিনি মনে করতেন, কর্মীর আগে নেতা গুলিবিদ্ধ হবে। একেকজনের একেক রকম ভাবনা। আমি বিশ্বাস করিনা এটি আট দশটা মৃত্যুর মত অত স্বাভাবিক কোনও মৃত্যু। আমি জানিনা উনি ভয়াবহ কোন মানসিক যাতনায় ছিলেন কিনা !!
* উনি যেমন করে হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেন, ঠিক তেমন কিসিমের হার্ট এ্যাটাকে গত এক যুগে গতজন গুরুত্বপুর্ন ব্যাক্তি মারা গিয়েছেন সেটা কি কেউ কাউন্ট করেছেন ? ‘অনেক মুল্য দিতে হবে- কথাটা বলতে গিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। স্থির হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কি বলব বুঝতে পারছি না- এ দৃশ্যটা ছবির মত আমার চোখে এখনো লেগে রয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ এ্যাড. নজরুল ইসলাম । ২০২০ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | দৈনিক ভোরের খবর,খন্দকার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান। অফিসঃ ১৫০ নাহার ম্যানসন (৫ম তলা) মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকা,ঢাকা -১০০০। বার্তাকক্ষ-+৮৮০১৭৪৫-৩৫৪২৭৭