মোঃ সাফিউল আজীম খানঃ
ম্যাচ জেতানোর মুরোদ নাই, কথা বলার গুঁসাই। একজন আয়নায় মুখ দেখান, অন্যজন দোষ খুঁজে একহাত নেন। যে সমর্থকদের তাচ্ছিল্য করা হয়েছে তারাই গতকাল ছুটে এসেছেন মাহমুদউল্লাহদের উজ্জীবিত করতে। গাঁটের পয়সা খরচ করে, গলা ফাটিয়ে দেশের জয় দেখতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটারদের মাধ্যমে। আরাধ্য সে জয় অধরাই থেকে গেল আরও এক ম্যাচে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে জেতা ম্যাচ হারল ৩ রানে। সুপার টুয়েলভে জয়ের আশা ফিকে হয়ে রূপ নিল মরীচিকায়। ‘কথামালা’রা খেলা শেষ করে সাফসুতরো হয়ে ফিরে গেলেন হোটেলে, মাঠে রেখে গেলেন হৃদয়ভাঙা এক হারের ছাপ। টি২০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্নের মৃত্যু ঘটল টানা হারের মধ্য দিয়ে। শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ডের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারায় বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভের বাকি দুই ম্যাচ হয়ে গেছে আনুষ্ঠানিকতা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ৪ নভেম্বর যার পরিসমাপ্তি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৪২ রানে বেঁধে রাখায় জয়ের আশায় বুক বেঁধেছিলেন সমর্থকরা। ১৪৩ রান বড় কোনো টার্গেট না হওয়ায় জয়ের স্বপ্ন দেখাও স্বাভাবিক। ১৫ ওভার পর্যন্ত লিডে থাকা দল হারতে পারে, কল্পনাও করা যায় না। ওপেনিং জুটি পরিবর্তন করা হলেও পাওয়ার প্লেতে ক্যারিবীয়দের সামনে ছিল। দুটি করে উইকেট হারিয়ে ২৯ রান উভয় দলের। মাঝের ওভারগুলোতে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। ১৫ ওভার শেষ করে ৪ উইকেটে ৯৯ রানে। জিততে শেষ ৩০ বলে করতে হতো ৪৪ রান। লিটন কুমার দাস ও মাহমুদউল্লাহ জুটি সেটও হওয়ায় জয়টা সময়ের ব্যাপার মনে করা হচ্ছিল। মাহমুদউল্লাহরা সেখান থেকেই ম্যাচটিকে নিয়ে গেলেন শেষ ওভারের শেষ বলে। ছয় বলে ১৩ থেকে এক বলে ৪ টার্গেট হয়। শেষের সে কাজটুকুও করতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। নার্ভাস হয়ে বলেই ব্যাট লাগাতে পারেননি।
উইন্ডিজের ১৪২ রান বেশি মনে করা হলে সে দায়ও মাহমুদউল্লাহদের। বাজে ফিল্ডিংয়ের খেসারত বলা যেতে পারে। তিনটি ক্যাচ ও একটি স্টাম্পিং মিস করা দলের পক্ষে প্রতিপক্ষকে কম রানে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। যে কারণে বোলারদের অর্জন বিসর্জন গেল দিন শেষে। বোলিংয়ের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। ওপেনিং ওভারে চার রান খরচ মেহেদির। তাসকিন, মুস্তাফিজ, শরিফুলরা মিলে পাওয়ার প্লেতে বিস্ম্ফোরক হতে দেননি ক্রিস গেইলদের। বরং ফিজ ও মেহেদির ব্রেক থ্রু পাওয়ায় চাঙ্গা ছিল দল। এভিন লুইসকে ফিজ আর ইউনিভার্স বস ক্রিস গেইলকে হতাশ করেন মেহেদি। শেষের এক ওভার বাদ দিলে
মেহেদির বোলিং ছিল ক্ল্যাসিক। ৩ ওভারে ১১ রান দেওয়া এ অফস্পিনার শেষ ওভারে দেন ১৬ রান। নিকোলাস পুরান প্রথম বলেই ছয় মারায় নার্ভ হারান মেহেদি। দুটি ছয় দেন ওভারে। ১৬তম ওভারটিও ছিল ব্যয়বহুল। একই জায়গা দিয়ে পর পর দুই ছক্কা হাঁকিয়ে সাকিবের হৃদয় পোড়ান ব্যাটার পুরান। ক্যারিবীয় এ ব্যাটসম্যান দুই রানে জীবন পেয়ে ২২ বলে করেন ৪০ রান। ঝোড়ো ইনিংসটি সাজান চার ছক্কা ও একটি চার দিয়ে। পুরানের ২ রানে লিটন কুমার দাস স্টাম্পিং মিস করার খেসারত দেয় বাংলাদেশ।
স্লগের দুই ওভার বাদ দিলে দুর্দান্ত ছিল বোলিং স্পেল। শরিফুল ১৭ ও ১৯তম ওভার দুটি হৃদয়ে ধারণ করে রাখার মতো। দ্বিতীয় স্পেলের এ দুই ওভারে ৮ রান দিয়ে দুটি উইকেট শিকার তার। ১৯তম ওভারে জোড়া উইকেট নেন। পুরানের পর রস্টন চেজকে সাজঘরে ফেরান। পুরান ক্যাচ আউট হলেও চেজ বোল্ড। উইন্ডিজ এ দুই ব্যাটারকেই ইনিংস গড়ার সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ দল। ৯ ও ২৭ রানে মেহেদি দু’বার রস্টনের ক্যাচ ফেলেন। রিটার্ন ক্যাচ ফেলে নিজে আর বাউন্ডারিতে দ্বিতীয়বার ক্যাচ ফেলে সাকিবকে উইকেট বঞ্চিত করেন। লিটন স্টাম্পিং করতে পারলে পুরানের উইকেটটিও সাকিবের হতো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মোট রানের দুই-তৃতীয়াংশ রস্টন ও পুরানের। দু’জনে মিলে করেন ৭৯ রান। অথচ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ৬৮ রান কম যোগ হতো স্কোর বোর্ডে। ডিপ কাভারে জেসন হোল্ডারের ক্যাচ ফেলেন আফিফ হোসেন। তিনটি ক্যাচ ফেলা ও একটি স্টাম্পিং বাজে ফিল্ডিংয়ের নমুনা। বোলাররা ১৫ ওভার পর্যন্ত উইন্ডিজকে বিস্ম্ফোরক ব্যাট করতে দেননি। নিয়মিত বিরতিতে জুটি ভাঙায় ৮৪ রান ছিল ক্যারিবীয়দের। পুরান, হোল্ডার মারকুটে ব্যাটিং করায় শেষের পাঁচ ওভারে থেকে ৫৮ রান পায় দলটি। সাকিব-মেহেদির দুই ওভার থেকেই তো ৩১ রান তোলে তারা। স্লগে কম করে হলেও ২০টি রান বেশি দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহরা।
নুরুল হাসান সোহানের চোট থাকায় একাদশে দুটি পরিবর্তন করে দল। সোহানের জায়গায় সৌম্য সরকার আর বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদের জায়গায় নেওয়া হয় তাসকিন আহমেদকে। বোলার তাসকিন সফল হলেও সৌম্য আবারও ব্যর্থ। চার নম্বরে নেমে ১৩ বলে ১৭ রান করে গেইলের হাতে ক্যাচ দেন। শ্রীলঙ্কার কাছে হারের কারণ হিসেবে যাকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল সেই লিটন লম্বা সময় ক্রিজে ছিলেন। তিন নম্বরে নেমে শেষ ওভারে আউট হন। টানা ফেল করায় আত্মবিশ্বাস তলানিতে লিটনের ব্যাটিং অর্ডার পেছনে নেন কোচ। নাঈম শেখের সঙ্গে ব্যাটিং ওপেন করেন সাকিব আল হাসান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবার ওপেন করতে নামা সাকিব ১২ বলে ৯ রান করে রাসেলের শিকার হন। নাঈমও সতীর্থকে অনুসরণ করে ফেরেন ১৯ বলে করেন ১৭ রান নিয়ে। ৯০ রানে ৪ উইকেট হারালেও লিটন মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন। শেষ ৩০ বলে ৪৪ রান করতে হতো বাংলাদেশকে। সিঙ্গেলসের ফাঁকে ফাঁকে একটি দুটি চার-ছয় মারতে হতো টার্গেটে পৌঁছাতে। মাহমুদউল্লাহ-লিটন পরিকল্পনামতো খেলতে না পারায় হাতের মুঠো থেকে ম্যাচ দূরে সরে যেতে থাকে। ১২ বলে ২২ লাগে জিততে। ডোয়াইন ব্রাভো ও আন্দ্রে রাসেলকে মোকাবিলা করে টার্গেট রানে যেতে পারেননি মাহমুদউল্লাহরা। শেষদিকে দেখে মনে হচ্ছিল, ব্যাটিংটাই ভুলে গেছেন তারা। মনে পড়ে যায়, ২০১৬ সালের টি২০ বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুতে স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে টাইগারদের হারের স্মৃতি।