মোঃ সাফিউল আজীম খানঃ
আবেগী মানুষ গিজ গিজ করছে আমাদের দেশে। আবেগ থেকে আতিথেয়তার নানা বাস্তব কাহিনিও আমাদের অনেকের জানা আছে।
বাড়িতে অতিথি এলে ঘরে কিছু না থাকলেও নিজের দারিদ্র্য বা অভাব গোপন করে আপ্যায়ন করার জন্য খুপরির একমাত্র ডিমপাড়া মুরগিটি জবাই করে দাওয়াত খাওয়ানোর ঐতিহ্য আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো প্রচলিত।
শহরের ছাত্রাবাসে শোয়ার জায়গা না থাকলেও একটি কক্ষে মেঝেতে যতজন শোয়া যায়, ততজন শিক্ষার্থীকে ঠাঁই দেওয়া হয় এখনো। কিছু না থাকলেও মায়া-মমতায় জড়াজড়ি করে বাস করা যেন আমাদের কৃষ্টি, আমাদের অস্থি-মজ্জার সঙ্গে মিশে আছে।
এ তো গেল আমাদের চিরায়ত আত্মার বন্ধনের কথা। কিন্তু আজকাল দিন বদলেছে। আবেগ থেকে অতি আবেগ, ভালো আবেগ থেকে অতি মন্দ আবেগ আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিয়েছে। মানুষের মনুষ্যত্ব হারিয়ে গেছে। ভালো বিবেক মন্দ আবেগের কাছে বন্দি হয়ে পড়ছে।
চারদিকে অঘটন-ঘটনপটীয়সীরা ষড়যন্ত্র করে যন্ত্রণা তৈরি করে চলছে। লোভ-লালসা, মিথ্যা, চালাকি, দখলবাজি দেশের মাথা থেকে পা পর্যন্ত গেঁথে বসেছে। সেটা থেকে প্রতারণা, ঘুষ-দুর্নীতি, জালিয়াতি, বাটপারি মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
শুধু অভাব নয়, বরং অবৈধ পন্থায় গজিয়ে ওঠা বিত্তশালীদের ঘরে জন্ম নিচ্ছে অপরাধের নতুন ছানা-পোনারা। অনবরত অবহেলা, অযত্নে ফুলের মতো শিশুরা প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে ভয়ংকর অপরাধী হয়ে উঠছে।
পরিবারে নিজ শিশুদের ছোটখাটো অপরাধকে বাবা-মায়েরা পাত্তা না দেওয়ার ফলে তারা গোপনে ভয়ংকরভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। গড়ে তুলছে কিশোর গ্যাং।
সম্প্র্রতি শাহরুখ খানের ছেলের সঙ্গে এক অভিজাত ঘরের সন্তানদের নিয়ে বিলাসবহুল সমুদ্র ভ্রমণের আড়ালে মাদক পার্টির কাহিনি ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। আমাদের দেশে কিশোর অপরাধের মাত্রা বেড়ে গিয়ে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সামাজিক স্থিতিশীলতার গাঁথুনি। বিনষ্ট হয়ে পড়ছে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি ও সৌহার্দ্য।
চিহ্নিত গডফাদারদের হস্তক্ষেপে নিষ্ক্রিয় হতে চলেছে অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারীদের কর্মকাণ্ড। এক ঘৃণ্য সামাজিক কৃষ্টি লালন করার প্রবণতা গোটা সমাজ ও দেশকে এক ভয়ংকর ভাঙনের মুখে ঠেলে দিয়েছে। শুরু হয়েছে নিত্যনতুন রূপকথার নাটক তৈরির হিড়িক। এ থেকে ঘুষ-দুর্নীতি আরও বেশি লাই পেয়ে বটবৃক্ষে পরিণত হতে চলেছে। আমরা খবরে কী দেখছি, কী-বা শুনছি প্রতিদিন?
২৬ অক্টোবর রাজনৈতিক সহিংসতা বাদ দিয়ে শুধু জমিজমা ও পারিবারিক কলহ থেকে ১১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ধানখেতে ছয় বছরের শিশু জেমির বস্তাবন্দি লাশ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেতা মুহিবুল্লাহ খুনের পর আরও সাতজন খুন, ছাদ থেকে লাফিয়ে নারীর আত্মহত্যা, কোনো একটি পরিবারের তিনজন সদস্যের গলাকাটা লাশ-এসব খবর পড়তে হয়েছে সংবাদপত্রে।
করোনা, ডেঙ্গি চলা অবস্থাতেই বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক হতাশা ও অস্থিরতা থেকে এসব অপমৃত্যু ও খুনের ব্যাপকতা শুরু হয়ে গেছে। এ কোন ভঙ্গুর অশান্তিকর সমাজে বাস করছি আমরা?
সামাজিক অস্থিরতা থেকে মানুষের চিরায়ত নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে গিয়ে এক নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এটাই যেন আমাদের সামাজিক শিক্ষা। সম্প্রতি পূজাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা ছড়ানোর মতো উসকানি দেওয়ার উপাদান আমাদের সমাজের কিছু মানুষ ছড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেনি।
এর পরিণতি তারা জেনেও না জানার ভান করেছেন এবং এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছেন।
এর শেকড়ের গভীরতা মাটির অনেক ভেতরে রয়েছে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থাকার আভাস পেয়েছেন অনেকেই। সম্প্রতি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের বর্বর বিমান হামলা কেন ছিল? সেটা অনেকেই জানেন। এর কিছুদিন পর তাইওয়ানের ওপর শত শত বোমারু বিমানের বারবার চক্কর দেওয়ার ভিডিও অনেকেই দেখেছেন।
এগুলো কিসের আভাস? বর্বর যুগের মাৎস্যন্যায় কি আধুনিক সভ্য মানুষ মেনে নেবে? কোনো জাতির মানুষের দেহের মধ্যে একবিন্দু রক্ত থাকতে তা হতে দেওয়ার কথা নয়। তবুও মানুষ সবকিছু শুধু নিজের করে দখলে নিতে চায়। লোভ-লালসা মানুষের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি।
তা না হলে একটি বাস দুর্ঘটনায় পতিত হলে কেউ মানুষের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে যায়, কেউ যায় পকেটের মানিব্যাগ বা গলার স্বর্ণের অলঙ্কার খসিয়ে নিজের করে নিয়ে পালাতে। এই তো মানুষের ধর্ম এখন। আগে মানুষ মিথ্যা বলতে ভয় করত-এখন সত্যি কথা স্বীকার করতে ভয় পায়। পাছে কোনো বিপদ হয় সেই ভেবে মুখ তালাবদ্ধ করে রাখে।
এখন দুই ধরনের মানুষ সমাজে বাস করে। একদল অতি সাধারণ, অন্য দল উঠতি টাকাওয়ালা, যারা ভণ্ডামি করে। কেউ মুখে বলেন, চুরি করা মহাপাপ। আবার তিনিই কেউ চুরি করে এনে উপহার দিলে মহাখুশি হন। এমন মোনাফেক ব্যক্তিতে দুনিয়াটা ভরে গেছে। তারাই এখন মহারথী। তাহলে তাদের কে সামাল দেবে?
সাধারণের কান্না শোনার জন্য আর কে এগিয়ে আসার আছে? অসহায়দের কান্না শুনে যার এগিয়ে আসার কথা তারা তো আসে ধীরলয়ে, নিজের স্বার্থসিদ্ধির আশায়। এই যদি পরিস্থিতি, তাহলে সমাজের কল্যাণ হবে কোন অলৌকিক ব্যবস্থায়?
সত্য গর্তের ভেতরে ঢুকে গেলে সেই লুক্কায়িত সত্যকে গর্ত থেকে বের করে আনবে কে? আগামীর সূর্যরা তো মাদকাসক্ত। তারা হয়ে পড়েছে কিশোর অপরাধী, গড়েছে কিশোর-যুব গ্যাং কালচার। তাদের হাতে যে আধুনিক প্রযুক্তি আছে সেটাকে আমাদের সনাতনী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রুখতে অক্ষম আজ।
অনেক মেধাবী বিদেশে পাড়ি জমিয়ে আর দেশে ফেরার নাম নিচ্ছে না। বিদেশে বসে দেশের অপ-সিস্টেমের তামাশা দেখছে আর সমালোচনা করছে। কারণ, দেশে কাজ করতে তারা অনিচ্ছুক, দেশের জন্য ইতিবাচক সমালোচনা করতেও তারা নারাজ। বিপদ হতে পারে বলে তারা ক্রমাগত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এর নেতিবাচক দিক হলো ভালোদের সঙ্গে ভালো কিছুর প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়ে যাওয়া।
এভাবে সামাজিক ও মেধাগত শূন্যতা তৈরি হওয়ায় মেধাহীনরা অনৈতিক পন্থায় তোয়াজ-তোষণের রাজনীতিতে জায়গা দখল করে নিয়েছে। পীরগঞ্জের জেলেপল্লিতে আগুন লাগানোর ঘটনা কি কোনো নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যক্তির কাজ ছিল?
বিন্দুমাত্র সততার লেশ থাকলে সে মানুষের ঘরে আগুন লাগানোর কাজ করতে পারে? সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে একজন আইনপ্রণেতা দাবি করেছিলেন-কোনো পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজন চাকরি করতে পারবে না! এটা কোন ধরনের মূর্খতা? নারীরা কি সারাজীবন নির্ভরশীল থাকবে? শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না? এভাবে জাতীয়ভাবে দেশে গণ্ডমূর্খরা নীতির কারিগর হচ্ছে।
মেধাশূন্যতা তৈরি হওয়ায় আমরা দিন দিন বেশি বেতন দিয়ে ভাড়া করা বিদেশি মেধার কাছে ধরনা দিতে বাধ্য হচ্ছি। মেগা প্রজেক্টে বিদেশি কনসালটেন্ট আমদানি করছি। কাজ শেষে ওরা নিজ দেশে চলে যাওয়ার পর আমাদের কোনো বিপদ হলে কে রুধিবে তখন?
করোনাকালে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ডিজিটাল নেটের ফাঁদে আমরা জড়িয়ে গিয়েছি। এ থেকে ফায়ারওয়াল নামক প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য যে কুশলী মানুষ ও শ্রম দরকার, তা আমাদের খুব সেকেলে। একজন অনভিজ্ঞ ডাক্তার যেমন রোগ ধরতে না পেরে রোগীকে এক বোঝা ওষুধ দেন, তেমনি আমাদের দেশে একটি দুর্ঘটনা বা নিছক ঘটনা ঘটলে হাজার নিরপরাধ মানুষকে গ্রেপ্তার করে হয়রানি করার ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। এমন বাস্তবতা আজ আর গুজব নয়। আজকাল গুজবকে সত্যি ও সত্যিকে গুজব বলার প্রবণতা তৈরি করা হয় সুকৌশলে। এ জন্য মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে সমাজে হতাশা নিয়ে বসবাস করে। ফলে একটি ছোট সন্দেহ বড় সন্দেহ সৃষ্টি করে। সেটাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি করা হয়। এসব সত্যি কথা বলতে গেলে মহারথীরা সাফাই গেয়ে অপরাধীদের আড়াল করার জন্য তৎপর হন। ফলে সমাজে অপরাধীরা ভয় তো পাচ্ছেই না, অধিকন্তু দিন দিন আরও বেশি অপরাধ করার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।