মোঃ সাফিউল আজীম খানঃ
চলমান করোনা সংক্রমণ কমতে শুরু করায় পুরোদমে চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বারবার উদ্যোগ নেওয়ার পরও করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় পিছু হটে কর্তৃপক্ষ। নানা মহল থেকেও দাবি উঠছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা করণীয় চূড়ান্তে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। সংক্রমণ মোকাবিলা করে কিভাবে পরীক্ষা, ক্লাসসহ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়-সে ব্যাপারে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করছেন তারা। ইতোমধ্যে স্কুল-কলেজের ক্যাম্পাস পরিষ্কার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর প্রাথমিকের সব শিক্ষককে স্কুলে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। এদিকে মঙ্গলবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক জরুরি বৈঠক করে। এতে সিদ্ধান্ত হয়, যদি ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে হলগুলো খুলে দেওয়া হবে। পাশাপাশি অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা চালু থাকবে। বলতে গেলে সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতিই নিয়ে রাখছে। এখন শুধু সরকারের উচ্চপর্যায়ের সবুজ সংকেতের অপেক্ষা।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সার্বিক প্রস্তুতি আছে। সংক্রমণের হার ক্রমেই নিচে নেমে আসছে- এটা আমাদের জন্য সুখবর। এ নিুগতি থাকলে খুব শিগগিরই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারব। তবে ধাপে ধাপে খোলার কথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমাদের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি। কারণ এ অসুখে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সবাই শুরু থেকেই সপ্তাহে ৬ দিন হয়তো ক্লাস করার সুযোগ পাবে না। একটু সময় নিয়ে হবে সেটা। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি আছে। শুধু অপেক্ষা সংক্রমণের হার আরেকটু নিচে নামার। এদিকে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনও প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন। তিনি জানান, স্কুল খোলার সব প্রস্তুতি আমাদের আছে। স্কুলগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষকরা স্কুলে যাচ্ছেন। আমরা অনলাইন ও অফলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছি। সংসদ টিভিতে ক্লাস হচ্ছে। স্কুল বন্ধ থাকলেও আমাদের শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছে। তাদের ওয়ার্কশিট দেওয়া হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এবং অন্যান্য ক্লাসের সমাপনী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, স্কুল খোলার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা লাগবে। এখন যে পরিস্থিতি হুট করে স্কুল খোলা যায় না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন। স্কুল খোলার বিষয়ে আমাদের সব প্রস্তুতি আছে। প্রধানমন্ত্রী যদি আজকে নির্দেশ দেন আমরা আগামীকাল থেকেই স্কুল খুলতে প্রস্তুত আছি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘যে কোনো সময় স্কুল খুলতে পারি, তখন যেন আমরা শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারি। শিক্ষকদের স্কুলে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যা কিছু লাগে, পড়ালেখার পরিবেশ যেন থাকে সেটা আমরা দেখছি। স্কুল খুললে যেন শিক্ষা কার্যক্রম চালানো যায়, সেজন্য স্কুলের ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে বলা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, বিজ্ঞজনরা স্কুল খোলার বিষয়ে মত দিচ্ছেন। দীর্ঘ দেড় বছর ধরে আমাদের বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে না। তারা নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছে। অনলাইনেও আমাদের কিছু ডিস্টার্ব হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বাজে গেমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। করোনা পরিস্থিতি যদি অস্বাভাবিক থাকে, তাহলে সরকার গত বছরের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেক্ষেত্রে, শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজের ওয়ার্কশিট মূল্যায়ন করে তাদের মান যাচাই করা হবে।
এদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকার উচ্চতর পর্যায় ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। টিকা দেওয়া শেষ হলে সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার চিন্তাভাবনা। তবে কয়েকদিন আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেওয়া হবে। যাতে সবাই প্রস্তুতি নিতে পারে। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেপ্টেম্বরেই সচল হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সাত কলেজে ১ সেপ্টেম্বর থেকে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ৮ সেপ্টেম্বর থেকে মাস্টার্সের স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে। এভাবে অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটি পরীক্ষা নিচ্ছে, আবার কোনোটি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে।
এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পাঠদানের জন্য উপযোগী করে তুলতে প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে মঙ্গলবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষককে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার উপযুক্ত রাখতে মাউশি থেকে আঞ্চলিক পরিচালকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ডেঙ্গি প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এক সপ্তাহের মধ্যে শতভাগ বিদ্যালয় পরিদর্শন, ওয়ার্কশিট বিতরণ শতভাগ নিশ্চিতকরণ ও যাচাই করা, শিখন ঘাটতির অবস্থা ও ফিডব্যাক নেওয়া, বিদ্যালয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করা, হোম ভিজিট যাচাই করা, শিক্ষার্থী প্রোফাইল শতভাগ হয়েছে কিনা তা দেখা, দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য করণীয় নির্ধারণ করা, স্যাম্পল হিসাব শিক্ষার্থীদের বাড়ি যাওয়া এবং তাদের যোগাযোগ রেজিস্টার যাচাই করা। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রস্তুতির অংশ হিসাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়াশ ব্লক ঠিক করার জন্য দ্রুত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম সাংবাদীকদের বলেন, শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সহকারী উপজেলা ও থানা শিক্ষা অফিসারদের এক সপ্তাহের মধ্যে সব বিদ্যালয় পরিদর্শন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো কর্মকর্তা যদি নির্দিষ্ট এলাকার সব বিদ্যালয় পরিদর্শন না করেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া ডেঙ্গি প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সংক্রমণ কমছে। কিন্তু ৫ শতাংশের নিচে আসার বিষয়টি এখনো সময়সাপেক্ষ। তাই এ মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ৭ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩ লাখ ৬৩ হাজার ২২২ শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। তাদের মধ্যে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৪২৬ জন টিকা নিয়েছেন। বাকি আছেন প্রায় ৮৪ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধিত ৩৪ হাজারের বেশি শিক্ষকের মধ্যে ৩০ হাজার টিকা পেয়েছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ১ লাখ ৭৯ হাজার ২৬১ শিক্ষার্থী টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। যাদের মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ৭৯ হাজার ৯১৪ জন। আর উভয় ডোজ পেয়েছেন ৬ হাজার ৭২জন।