ভারত ও নেপালের পর এখন বাংলাদেশ। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখন বাংলাদেশে আক্রমণ শাণিয়েছে। এর ফলে ১লা জুলাই থেকে এক সপ্তাহের জন্য দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। বর্তমান এই দুর্ভোগের জন্য বাংলাদেশের অনেকে ভারতকে দায়ী করছেন। অন্যদিকে টিকার জন্য শুধু ভারতের ওপর নির্ভর করার কারণে সমালোচিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। এই যুক্তিতে, আওয়ামী লীগ সরকার যদি শুধু ভারতের ওপর নির্ভর না করতো, তাহলে এরই মধ্যে দেশের বেশির ভাগ নাগরিককে টিকাদানে সক্ষম হতো বাংলাদেশ। এসব কথা লিখেছে ভারতের অনলাইন আউটলুক ইন্ডিয়া। এতে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশিরা বলছেন- সর্বোপরি বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে আগেভাগেই।
যদি ভারত থেকে টিকা আমদানি স্থগিত না হতো, তাহলে পরিস্থিতি এমন হতো না।
সাধারণ বাংলাদেশিদের মধ্যে যে উৎপীড়ন দেখা দিয়েছে তা হলো, শুরুতে বিনামূল্যে চীনের সিনোফার্ম টিকা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তা প্রত্যাখ্যান করেছে ঢাকা। ভারত যেহেতু প্রয়োজনীয় ডোজগুলো দিতে চেয়েছিল, তাই চীনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য ঢাকার ওপর নয়া দিল্লির প্রচণ্ড চাপ ছিল। ভারত ও চীন উভয়েই আগ্রাসী টিকা বিষয়ক কূটনীতি শুরু করেছে। এর মাধ্যমে তারা এশিয়া এবং বিশ্বজুড়ে টিকা সরবরাহ দিয়ে বন্ধুদের মন জয়ের আশা করেছে। এসব ঘটেছে এমন সময়ে, যখন উন্নত বিশ্ব তার নাগরিকদের জন্য বিপুল পরিমাণ টিকা দেয়ার জন্য অর্থ সরবরাহ ও অর্ডার দিচ্ছিল।
ভারতের ওপর নির্ভর করে চীনের বিনামূল্যের টিকা দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু যখন দ্বিতীয় ঢেউ করোনা মহামারি ভারতকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার টিকা রপ্তানির মতো কোনো অবস্থানে ছিল না। ফলে ঢাকা আবার যখন চীনের মুখাপেক্ষী হয়, তখন চীন টিকার জন্য অর্থ দাবি করে বসে। এক ডোজ টিকা বাংলাদেশে ১০ রুপি, যা খুব বেশি দাম নয়। কিন্তু যে টিকা বিনামূল্যে দেয়ার কথা ছিল, তা এখন অর্থ দিয়ে কিনতে হচ্ছে। চীনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন করছে জনগণ। অনেকেই মনে করছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক আছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের বড় অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরদিন স্মরণ করা হবে। তার অর্থ এই নয় যে, দিল্লির সিদ্ধান্ত (ডিকটেশন) মেনে চলতে হবে ঢাকাকে। সর্বোপরি, যখন মানুষের জীবন ঝুঁকিতে।
প্রকৃতপক্ষে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা যেন সেটা লুফে নেয়। ৩ কোটি ডোজ টিকা কেনার জন্য সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার (এসআইআই) সঙ্গে ২০২০ সালে একটি চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। অর্থও পরিশোধ করা হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে কোভিশিল্ড টিকা পাওয়ার কথা ঢাকার। কিন্তু প্রথম দুই মাসে সেরাম মাত্র ৭০ লাখ টিকা সরবরাহ দিয়েছে। যখন রপ্তানি বন্ধ হয়েছে, তখন ঢাকাকে টিকা সরবরাহ দেয়ার মতো অবস্থানে ছিল না সেরাম। ভ্যাক্সিন মৈত্রী কর্মসূচির শুরুতে, বিনামূল্যে ২০ লাখ ডোজ কোভিশিল্ড টিকা পায় বাংলাদেশ। প্রথম কোনো দেশ এভাবে বিনামূল্যে টিকা পেয়েছে। বাংলাদেশকে ৩ কোটি ডোজ টিকা দেয়ার কথা ভারতের। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজস্ব জনসাধারণকে টিকা নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত টিকা না থাকার কারণে, দিল্লি এখন আর কাউকে টিকা দেয়ার মতো অবস্থানে নেই।
টিকা কেনার সিদ্ধান্তের পর থেকে বাংলাদেশ ঝাঁকুনি খেয়েছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মডার্নার ২৫ লাখ ডোজ টিকা পৌঁছেছে ঢাকায়। চীনও তার অংশ পাঠাচ্ছে। ঢাকাকে টিকা দেয়ার লাইনে আছে ফাইজার এবং জনসন অ্যান্ড জনসন।
এরই মধ্যে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বাংলাদেশ সরকার। ঢাকা থেকে পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারের মধ্যে মারা গেছেন ১৩২ জন। এ নিয়ে বাংলাদেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৪,৭৭৮ জন। এ সময়ে নতুন করে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছে ৮৪৮৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অফিস থেকে দেয়া তথ্যমতে, এসব হলো সরকারি হিসাব, যা পুরো দেশের ওপর প্রণয়ন করা হয়েছে।
করোনা বৃদ্ধি সত্ত্বেও প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে উন্নত উপায়ে করোনা মহামারি মোকাবিলা করছে শেখ হাসিনার সরকার। ভারতে যেমন এম্বুলেন্সে অক্সিজেনের জন্য রোগী হাসফাঁস করছিলেন, তেমন ভয়াবহ দৃশ্য বাংলাদেশে ঘটেনি। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত মারাত্মক রোগীদেরকে অব্যাহতভাবে অক্সিজেন সরবরাহ দিতে হয়। এখন দেশের বেশির ভাগ এলাকায় অক্সিজেন সরবরাহ আছে। তবে কিছু জায়গায় অক্সিজেন সঙ্কটের রিপোর্ট পাওয়া গেছে। বগুড়া থেকে অক্সিজেন সঙ্কটের জন্য ১৩ জন রোগী মারা যাওয়ার রিপোর্ট পাওয়া গেছে। কিন্তু ঢাকায় সরবরাহ পর্যাপ্ত। সরকার দ্রুততার সঙ্গে উচ্চ প্রবাহযুক্ত অক্সিজেন ক্যানুলা পাঠাচ্ছে বগুড়ায়।
বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে দিনে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ টন থেকে ২০০ টন পর্যন্ত। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দেশের কোথাও বেডের সঙ্কট নেই। অক্সিজেন সরবরাহও চলছে ঠিকমতো। কিন্তু জরুরি সরবরাহ দ্রুততর করা হয়েছে।