মোঃ সাফিউল আজীম খানঃ
করোনার ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত দেশ। দানবীয় রূপ নিয়েছে এ মহামারি। দিন দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। সংক্রমণও ঊর্ধ্বমুখী। শুধু শহর নয়, জেলা-উপজেলা এমনকি প্রত্যন্ত এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি।
ফলে সারা দেশেই বাড়ছে মৃত্যু ও শনাক্ত। প্রতি মিনিটে প্রায় আটজন করে নতুন শনাক্ত হচ্ছেন। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় প্রতি মিনিটে ৩ জনকে নেওয়া হচ্ছে আইসোলেশনে। ২৭ জুন থেকে প্রতিদিন শতাধিক লোকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনা। এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুর ১০ ভাগের ১ ভাগ হয়েছে গত ১১ দিনে। এ সময়ে ১৫৪০ জন মারা গেছেন।
মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে পনেরো হাজার। এর মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে মৃত্যু। একদিনে আক্রান্তদের মধ্যে ২০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা এ যাবতকালে সর্বাধিক। অঙ্কের হিসাবে প্রতি ৭ মিনিটে একজনের প্রাণ গেছে। এর আগে সোমবার সর্বোচ্চ ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়। সবমিলিয়ে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৫৯৩। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মৃত্যু বৃদ্ধি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেছেন, প্রায় ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি অক্সিজেন স্যাচুরেশন নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে আসছেন। দীর্ঘসময় শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকলে ব্রেন ড্যামেজ হতে শুরু করে। ফলে তাদের আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। এদিকে নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে শনাক্তের সংখ্যাও।
এখন সারা দেশে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় ৩৫ হাজার ৬৩৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে নতুন করে আরও ১১ হাজার ১৬২ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। আগের দিন শনাক্ত হয়েছিল ১১ হাজার ৫২৫ জন। এ নিয়ে দেশে করোনায় শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৮।
২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ। আগেরদিন এ হার ছিল ৩১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সরকারি হিসাবে ১ দিনে আরও ৫ হাজার ৯৮৭ জন সুস্থ হয়েছেন। এ পর্যন্ত সুস্থ হলেন ৮ লাখ ৫০ হাজার ৫০২ জন।
দুই সপ্তাহ ধরে রোগটিতে মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিনেই ভাঙছে আগের রেকর্ড। ২৭ জুন মারা যান ১১৯ জন। পরের দিন ১০৪ জন। ২৯ জুন ১১২ ও ৩০ জুন মারা যান ১১৫ জন। জুলাইয়ের শুরু থেকে আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। ১ জুলাই ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়। পরের দিন ১৩২ জন। ৩ জুলাই ১৩৪ জন মারা যান। ৪ জুলাই থেকে দৈনিক মৃত্যু দেড় শতাধিক ছাড়িয়ে যায়। ওইদিন মারা যান ১৫৩ জন। ৫ জুলাই ১৬৪ ও ৬ জুলাই মারা যান ১৬৩ জন। আর অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে বুধবার মারা যান ২০১ জন।
এদিকে সংক্রমণ বাড়ায় হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ। দেখা দিয়েছে অক্সিজেন সংকট। আইসিইউ সংকটে রোগীরা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন। রাজধানী ঢাকায় করোনা ডেডিকেটেড ১৬টি সরকারি হাসপাতালে ৩৮৪টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এরমধ্যে খালি আছে মাত্র ৮৫টি। এসব হাসপাতালের কয়েকটিতে সাধারণ শয্যাও ফাঁকা নেই। কয়েকটি প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করা হয়েছে।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ বলেন, করোনার ভয়াবহতায় হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছেই। আমাদের হাসপাতালে আর নতুন রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই।
সারা দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখী। খুলনা, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে রোগটি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ৬৬ জনের মৃত্যু হয়। ঢাকা বিভাগের মারা গেছেন ৫৮ জন। ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা জেলায় (মহানগরসহ) ৩ হাজার ২৮৫ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। সংক্রমণের হার ২৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আগের দিন শনাক্তের হার ছিল ২৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। লালমনিরহাট জেলায় শনাক্তের হার ৭৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেছেন, দেশে প্রতিনিয়ত করোনা রোগী বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে হাসপাতালে রোগীর চাপ। রোগীদের সেবা নিশ্চিতে জনবলের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে যাদের মৃত্যু হচ্ছে তাদের বেশিরভাগের বয়স ৫০ বছরের উপরে।
তবে রোগের বিস্তারের শেষ পর্যায়ে না এসে রোগ ধরা পড়ার পর দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। মহাপরিচালক বলেন, করোনা সংক্রমণ কমাতে হবে। না হলে সেবা বাড়িয়েও চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬০৫টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১৩০টি, জিন এক্সপার্ট ৪৮টি, র্যাপিড অ্যান্টিজেন ৪২৭টি। এসব ল্যাবে ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ হয়েছে ৩৭ হাজার ১৪৭টি। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৬৮ লাখ ২৯ হাজার ৮৩২টি। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৭ ও মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১১৯ ও নারী ৮২ জন।
সরকারি হাসপাতালে ১৬৫ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ২৩ জন ও বাড়িতে মারা গেছেন ১২ জন। হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আসেন একজন। মৃতদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ২১ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৮ জন, বরিশাল বিভাগে সাতজন, সিলেট বিভাগে নয়জন, রংপুর বিভাগে ১৪ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে আটজন রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ১১৫ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৪৭ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ২৫ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে নয়জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে একজন রয়েছেন।