হাসপাতালগুলো সব জনশূন্য। সরকারি অফিস-দপ্তর ফাঁকা। স্টেশনে স্টেশনে থমকে দাঁড়িয়ে ট্রেন। মিয়ানমারে জোর করে ক্ষমতা দখল করা জান্তা সরকারের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে দেশটির লাখ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।
গ্রেফতার-পুলিশি হয়রানি, নির্যাতন-নিপীড়ন এমনকি জীবন ও জীবিকা হারানোর ঝুঁকি নিয়ে টানা অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
অন্য দিকে সেনার নিয়োগ দেওয়া অল্প কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিসে এলেও তাদের প্রত্যাখ্যান করছে জনগণ। এর প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারী বিনে পঙ্গু হয়ে পড়েছে সরকার ও প্রশাসন। ফিকে হয়ে আসছে সেনাদের মিয়ানমার শাসন স্বপ্ন। দ্য ইরাবতি ও সিএনএ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে গত প্রায় চার সপ্তাহ ধরে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ‘সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স মুভমেন্ট’ (সিডিএম) নামে এই আন্দোলন মিয়ানমারজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
এতে সংহতি প্রকাশ করেছে কৃষক-মজুর-শ্রমিকসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ। জীবনের ঝুঁকি ও চাকরিচ্যুতির হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করেই কর্মবিরতি আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন সরকারি কর্মচারীরা। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় ইতোমধ্যে অনেককেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজোনারস’ তথ্য মতে, ইউনিয়ন পার্লামেন্টের ডেপুটি পরিচালক ও এক সিনিয়র কর্মকর্তাসহ চাকরি হারিয়েছেন অন্তত ৪৮ জন সরকারি কর্মচারী। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় বহু ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য খাতের স্টাফদের টার্গেট করা হয়েছে। তার পরও এতটুকু দমছে না কেউই। সেনা সরকার ও প্রশাসনকে অকেজো করে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
মিয়ানমারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও নজিরবিহীন এই আন্দোলনের ফলে দেশজুড়ে সরকারি অফিস-আদালতে ইতোমধ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেমনটি বলছিলেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থিডা (ছদ্মনাম)।
সোমবার এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই শিক্ষক বলেন, ‘সেনাবাহিনীকে প্রমাণ করুক, সরকার হিসাবে তারা দেশ চালাতে সক্ষম। কিন্তু আমরা… সরকারি কর্মচারীরা যদি কাজ না করি, তাদের অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে।’ করোনার কারণে গত কয়েক মাস ধরে শিক্ষার্থীদের অনলাইনেই পড়াচ্ছিলেন।
কিন্তু অভ্যুত্থানের পর গত তিন সপ্তাহ ধরে কোনো ক্লাস নিচ্ছেন না তিনি। থিডার মতো ক্লাস নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন আরও অনেক শিক্ষকই। গ্রেফতার এড়াতে গাঢাকা দিয়েছেন তারা।
সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত কাজ বন্ধ করে দিয়েছে বেসরকারি খাতের কর্মচারীরাও। অফিস ছেড়ে তারাও রাজপথে। ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন বন্ধ। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ব্যাংকও। সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্রমবর্ধমান এই প্রতিরোধ জান্তা সরকারের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।
কারণ কর্মচারীরা অফিসে না আসায় ট্যাক্স সংগ্রহ বন্ধ হয়ে গেছে, বিদ্যুৎ বিল বাকি পড়ে আছে, এমনকি বন্ধ রয়েছে করোনা পরীক্ষা ও টিকা কার্যক্রম। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে একের পর এক দেশের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। ফলে আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে সেনা কর্তৃপক্ষ।
মিয়ানমারে সরকারি খাতে অন্তত ১০ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। এর মধ্যে ঠিক কতজন চলমান অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে সাম্প্রতিক এক অনলাইন জরিপে দেখা গেছে, ২৪টি মন্ত্রণালয়ের সবই এখন আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।
জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারের এক হিসাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক-তৃতীয়াংশই এখন অফিস ছেড়ে আন্দোলনের ময়দানে। তাদের অনুপস্থিতিই সেনাশাসনের প্রতি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে হাজির হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এখন সেবা দিতে পারছে না।
চলতি সপ্তাহে এ কথা নিজেই স্বীকার করেছেন সেনাবাহিনী ও সরকারের প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখার পুরস্কার হিসাবে ডাক্তার ও শিক্ষকদের নগদ অর্থ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
এর পরও কাজে ফেরেননি চিকিৎসকরা। বিষয়টি স্বীকার এক ডাক্তার এএফপিকে বলেছেন, স্টাফদের অনুপস্থিতিতে নতুন রোগীদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে হাসপাতাল।