ঢাকায় করোনা টিকাদানের ঐতিহাসিক উদ্বোধন আজ। প্রাণঘাতী এ ভাইরাস রোধে বুধবার দেশে মানবদেহে প্রথম টিকা দেওয়া হবে। এজন্য রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনলাইনে যুক্ত হয়ে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন। এ সময় ২০ জনকে টিকাদান করা হবে। যাদের মধ্যে দুজন সাংবাদিক। বাকিরা সবাই চিকিৎসা ও চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট পেশায় নিয়োজিত। এর পরদিন রাজধানীতে টিকা কার্যক্রম শুরু করতে ৫টি হাসপাতাল তৈরি রাখা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে করোনার টিকা পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য আবেদন করেছে তিন প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একটি দেশি, অন্য দুটি বিদেশি। আবেদনগুলো গ্রহণ করেছে বিএমআরসি (বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল)।
জানা গেছে, দেশের ইতিহাসে প্রথম টিকা নেবেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু বেরোনিকা কস্তা। তার সঙ্গে আরও দুজন সিনিয়র স্টাফ নার্স মুন্নী খাতুন ও রিনা সরকারও টিকা নেবেন। এছাড়া চিকিৎসক হিসেবে প্রথম টিকা নেবেন মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. আহমেদ লুৎফর মবিন। ভ্যাকসিনেটর হিসাবে যারা টিকা প্রয়োগ করবেন তাদের মধ্যে সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনা আক্তার ও দীপালি ইয়াসমিনের নাম রয়েছে। প্রথম টিকা গ্রহীতা হিসাবে রুনা বেরোনিকার নাম থাকলেও তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ না থাকলে তালিকার অন্য দুজনের একজনকে টিকা দেওয়া হবে।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধনী দিনে টিকা দিতে আগ্রহী এমন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নামের তালিকা চাওয়া হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ, সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট একজন করে চিকিৎসকের নাম দেওয়া হয়েছে। এমনকি শিক্ষকের জন্য নাম চাওয়া হলেও সেখানে একজন চিকিৎসক অধ্যাপকের নাম দেওয়া হয়েছে। তাই আজ যাদের টিকা দেওয়া হবে তাদের মধ্যে দুজন সাংবাদিক ছাড়া বাকি সবাই চিকিৎসক ও চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট পেশায় নিয়োজিত।
এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বিকালে দেশে করোনা টিকা প্রয়োগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের পরপরই নিবন্ধনের জন্য অনলাইন ‘সুরক্ষা’ প্ল্যাটফরম খুলে দেওয়া হবে। মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে টিকা কার্যক্রম উদ্বোধনের প্রস্তুতি পরিদর্শন শেষে তিনি এ কথা জানান। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার ২০ জনকে টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হবে। সুরক্ষায় যারা নিবন্ধন করতে পারবেন না, তারা কেন্দ্রে গিয়েও নিবন্ধন করতে পারবেন। সেই ব্যবস্থা আমরা রেখেছি। দেশব্যাপী টিকা দেওয়ার জন্য আমরা নানা ব্যবস্থা নিয়েছি। আশা করি, ৭ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ব্যাপক হারে আমরা এ সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করতে পারব।
টিকা দেওয়ার অনুমতি ঔষধ প্রশাসনের : ভারত থেকে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের আনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৫০ লাখ ডোজ টিকা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচাপ্রক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, ভারত থেকে আসা টিকা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রথম চালানের লাখ ডোজ টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছেন তারা। তিনি বলেন, ‘প্রতিটা লটের নমুনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। বুধবার এই টিকা দিয়েই শুরু হবে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি। এই টিকাটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি। যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ সংস্থা এই টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে এবং সে দেশে এটি প্রয়োগ হচ্ছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডে বিশ্বমানের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। গত ১৬ জানুয়ারি থেকে ভারতে এই টিকা প্রয়োগ করছে। ভারতের সেসব কাগজ পরীক্ষা করা হয়েছে।’
টিকা দিতে প্রস্তুত ৫ হাসপাতাল : ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেলসহ আরও চারটি হাসপাতালে করোনার টিকা প্রয়োগ শুরু হবে। এগুলো হচ্ছে- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল। এসব হাসপাতালের ৪০০ থেকে ৫০০ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হবে- জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী তাদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। তাদের মধ্যে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কিনা সেটা দেখা হবে।
টিকা নেওয়ার প্রস্তুতি মোটামুটি ভালোই, সবকিছু প্রস্তুত হচ্ছে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক। টিকা নেওয়ার জন্য কতজন স্বাস্থ্যকর্মী প্রস্তুত করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে পরিকল্পনা রয়েছে ১০০ জনের মতো স্বেচ্ছাকর্মীকে টিকা দেওয়ার। তিনি জানান, হাসপাতালের পরিচালক হিসাবে প্রথম টিকা নিতে তিনি নিজেই আগ্রহী। এছাড়া হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, টেকনোলজিস্ট, আনসারসহ সব বিভাগ মিলিয়ে ১০০ জনকে বাছাই করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিচতলায় বুথ প্রস্তুত করা হয়েছে। পরিচালক বলেন, এখানে টিকা দেওয়ার পর পর্যবেক্ষণ করা হবে। সেজন্য ‘পোস্ট ভ্যাকসিন এরিয়া’ প্রস্তুত করা হয়েছে, সেখানে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আমিন বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি শেষ। সাধারণ মানুষের জন্য জাতীয়ভাবে টিকাদান কর্মসূচি চালু হবে তখন এ হাসপাতালে মোট আটটি বুথ থাকবে। প্রতিটি বুথে টিকা দেওয়ার জন্য দুজন নার্স এবং চারজন করে স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন। পোস্ট ওয়েটিং রুমে টিকা গ্রহীতাদের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে তারা ৩০ মিনিট পর্যবেক্ষণে থাকবেন। এ সময়ে তাদের পর্যবেক্ষণে থাকবে একটি মেডিকেল টিম। স্ট্যান্ডবাই আরেকটি মেডিকেল টিম থাকবে যেখানে একজন ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, দুজন রেসিডেন্স এবং একজন আইসিইউ বিশেষজ্ঞ থাকবেন। তিনি বলেন, সব বিভাগ থেকেই কয়েকজন করে নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুসারে ২০০ জনের তালিকা করা হবে। হাসপাতাল পরিচালক হিসাবে তিনি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়াও ভ্যাকসিন নিতে নিবন্ধন করেছেন।