ডেস্ক রিপোর্টঃ ‘৫০ বছর যদি থাকি আমি, তারপরও শহরটা আমার নিজের হয় নাই।’ টিভি পর্দায় মানুষটার দীর্ঘশ্বাস দেখে থাকতে পারেন। ছোট কোনো স্বপ্ন নিয়েই হয়তো এই শহরে আসেন বহুদিন আগে। এ মানুষদের খুব বেশি কিছু চাওয়ার থাকে না। বাচ্চারা একটু পড়ালেখা করুক। চলার মতো রুটি-রুজির ব্যবস্থা হোক। কোনো সংকট যে তাদের ছিল না এমন নয়। জীবনের সঙ্গে লড়াই দীর্ঘদিনের। বারবার হোঁচট খেয়েছেন, আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন।
কিন্তু কালান্তক করোনা তাদের জীবনে যে বিপর্যয় নিয়ে এসেছে তা অভাবনীয়। দীর্ঘকালে তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার মধ্যরাতে, সকালে অথবা দুপুরে তারা তুলে দিচ্ছেন পিকআপে। ফিরে যাচ্ছেন গ্রামে। অনেকদিন আগে যে গ্রাম ছেড়ে এসেছিলেন। কথা হচ্ছে, সেখানেও তাদের সামনে অপেক্ষা করছে অনিশ্চয়তা।
একদল ফিরে গেছেন বাড়ি। বাকিরা লড়ছেন এখনো এই শহরে। স্রেফ টিকে থাকার সংগ্রাম। জিডিপি, ঊর্ধ্বমুখী ইমারত, বড় বড় ওভারব্রিজ, মেট্রোরেল যে জীবনমানের প্রকৃত নির্দেশক নয় তা এখন আরো খোলাসা হয়ে গেছে। ভোগবাদী এই সমাজে মধ্যবিত্ত প্রায় সবসময়ই বিপদে ছিল। তাদের টিকে থাকাই ছিল কঠিন। জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়েছে সেভাবে তাদের মানিব্যাগ বড় হয়নি। পরিবারের সদস্যদের চাওয়া পাওয়ার অনেক কিছুই পূরণ হয়নি। যদিও তাদের কেউ কেউ নাম লিখিয়েছেন উচ্চবিত্তের খাতায়। কেউবা এমন জীবনে অভ্যস্ত হয়েছেন যার জোগান এখন আর দিতে পারছেন না। যে স্বল্প সংখ্যক বিত্তের চূড়ায় উঠেছেন, বেগমপাড়ায় ঘরবাড়ি করেছেন তাদের কথা আলাদা। কিন্তু চিরকালীন যে মধ্যবিত্তের জীবনটা সবসময়ই কঠিন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের দেয়া এক হিসাবমতে, বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের চার কোটি পরিবার রয়েছে। এরমধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। এই সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে।
পরিস্থিতি যে এতটা কঠিন হবে তা অবশ্য শুরুর দিকে আঁচ করা যায়নি। মার্চের শেষ সপ্তায় সাধারণ ছুটি বা লকডাউন শুরুর পর সবচেয়ে বিপর্যয়ে পড়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের বেশির ভাগই নিজেদের জীবিকা হারিয়ে ফেলেন। অনেকে শহর ছেড়ে চলে যান। এসব নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়াতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দেখা যায়। মধ্যবিত্তের ওপর আঘাতটা আসে আরেকটু পরে। সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শেষে তারা দেখেন হাতে কিছুই নেই। পরিবর্তিত সময়ে তারা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ছেন বাসা ভাড়া মেটাতে গিয়ে। এমনিতে তাদের টালি খাতার হিসাব মেনে চলতে হয়। যা বেতন পান দেখা যায় তার অর্ধেক চলে যায় বাসা ভাড়া মেটাতে। বাকি অর্ধেকে টেনেটুনে চলেন। কিন্তু এমন মধ্যবিত্তের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। তাদের জন্য এই শহরে টেকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বেতন আটকে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। কেউবা দু’মাসে একবার বেতন পেয়েছেন। বেতন কমে গেছে অনেকের। এমনকি কয়েকটি ব্যাংকও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমিয়েছে। অথচ গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকের চাকরিকে অন্যতম আকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বলা হচ্ছে, সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া কেউই আসলে ভালো নেই।
ঢাকায় চলার পথে একটু দৃষ্টি দিলেই দেখতে পাবেন টু-লেটের ছড়াছড়ি। বাসা ভাড়ার এত বিপুল সংখ্যক বিজ্ঞাপন আগে কখনো দেখেনি এ শহরের মানুষ। কিছু কিছু মহানুভব বাড়ির মালিক অবশ্য মহামারির এই সময়ে ভাড়া নিজ থেকেই কিছুটা কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এসব ব্যতিক্রমই। বাকি ভাড়াটিয়াদের জীবন ওষ্ঠাগত। তাদের কেউ কেউ অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় নতুন বাসায় ওঠেছেন। অনেক বাড়িওয়ালাও রয়েছেন বিপাকে। এমন সময়ে ভাড়াটিয়াও পাচ্ছেন না তারা। ঢাকা ছেড়ে দেয়া আর নতুন বাসায় ওঠার বাইরেও পাওয়া যাচ্ছে আরেক ধরনের খবর। কঠিন এ সময়ে জীবিকার টানে পেশা পরিবর্তন করেছেন কেউ কেউ। নানা ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিজেদের জড়িয়েছেন তারা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মানবজমিনকে বলেন, চাকরি হারানো এই মানুষগুলোর জন্য ঘুরে দাঁড়ানোটা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ তারা তো কর্মসংস্থান হারিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছে। সুতরাং কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে তো তারা বেকারই থেকে যাবে। আর যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয় না আগামী ১-২ বছরের মধ্যে দেশের মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। পোশাক খাত বাদ দিলেও অন্তত দেড় কোটি মানুষ চাকরি হারাতে বসেছে। এ সেক্টর ধরলে সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। সব কারখানায় কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশে বেকারের সংখ্যা দিন দিন ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, এই সংকট বেশিদিন স্থায়ী হলে মানুষের জীবনে বড় অন্ধকার নেমে আসবে। পরিবারগুলোতে লেখাপড়া, চিকিৎসা, খাবার সহ সব কিছুতে সংকট দেখা দেবে।
অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর মানবজমিনকে বলেন, শুধু স্বল্প আয়ের মানুষ নয়, মধ্য আয়ের মানুষসহ দেশের সব মানুষই এখন বিপদগ্রস্ত। দেশের বড় অংশের মানুষ ব্যক্তি খাতে কাজ করে থাকে। একদিকে মানুষ চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামীণ অর্থনীতিও চাপের মুখে পড়েছে। যেখানে গ্রামের মানুষ জীবন মান উন্নয়নের জন্য ঢাকায় আসেন সেখানে তারা ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তারা কর্মসংস্থান চায় সেখানে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে আসছে। দেশে বেকারত্বের সংখ্যা এমনিতেই বেশি ছিল। এ অবস্থায় নতুন করে হাজার হাজার মানুষ বেকার হচ্ছেন। এক্ষেত্রে আমরা শুধু প্রতিষ্ঠানকে দোষ দিচ্ছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কী করবে? প্রতিষ্ঠানতো ব্যক্তির। সমস্যাটা হলো- দেশের যে কর্মসংস্থান ছিল তা ধরে রাখার জন্য সরকারের কোনো পদ্ধতি নেই। কর্মসংস্থান ধরে রাখার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।