চীফ রিপোর্টারঃ করোনা ভাইরাস সন্দেহে ডাক্তার ও নার্সদের অবহেলায় কানাডা ফেরত এক শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত শনিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় নাজমা আমিন (২৪) নামের ওই ছাত্রীর। তার পরিবারের দাবি, করোনা ভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে চিকিৎসকরা অবহেলা করায় ওই তরুণীর মৃত্যু হয়েছে।
জানা যায়, নাজমা কানাডার সাসকাচোয়ানের রেজিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকে অধ্যয়নরত ছিলেন। তিনি গত সোমবার ঢাকায় ফিরে এসে পেটের ব্যথার কথা পরিবারকে জানান। পরিবারের সদস্যরা গণমাধ্যমকে বলেন, নাজমা কোন খাবার খেতে পারছিলেন না। খাওয়ার চেষ্টা করলে তার বমি বমি ভাব হচ্ছিলো আর পেটের ভীষণ ব্যথা হচ্ছিলো। এ অবস্থায় শুক্রবার রাতে তাকে মোহাম্মদপুরে বাসার পাশে একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তাকে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) এ রাখা দরকার। এরপর ঢামেকে ভর্তি করা হয়।
নাজমার চিকিৎসা নিয়ে বাবা আমিন উল্লাহ জানান, তার মেয়েকে ঢামেকে একটি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে স্যালাইন, অক্সিজেন সহায়তা এবং ওষুধ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরে সকাল আটটায় নার্সদের শিফট পরিবর্তন হয় এবং নার্সদের একটি নতুন ব্যাচ এসেছিল। সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে এক নার্স আমিনকে জিজ্ঞাসা করলেন নাজমার কী হয়েছে। লক্ষণগুলি বর্ণনা করতে গিয়ে আমিন উল্লেখ করেছিলেন মেয়েটি সম্প্রতি কানাডা থেকে এসেছে। এমন সময় নাজমার পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। কিন্তু কানাডার কথা উল্লেখ করতেই ওয়ার্ডের নার্সরা এই বলে চিৎকার করতে লাগল যে, সে কানাডা থেকে এসেছে! তারও জ্বর হয়েছে! তখন মেয়েটির করোনা ভাইরাস রয়েছে বলে তারা ডাক্তারদের কাছে ছুটে আসে। তখন পুরো ওয়ার্ডটিতে বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ডাক্তার এবং নার্সরা মেয়েটির কাছাকাছি আসতে অস্বীকার করেন। এর ফলে এক পর্যায়ে চিকিৎসার অভাবে তার মৃত্যু হয়।
যে ওয়ার্ডটিতে ওই তরুনী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন, সেখানকার কিছু কর্মীদের সঙ্গে কথা হয় গণমাধ্যমকর্মীদের। একজন ওয়ার্ড বয় জানান, কর্মীরা যখন শুনলেন যে কোনও করোনা ভাইরাসের রোগী ওয়ার্ডে প্রবেশ করেছে, তখন সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আমিও সেখানে ছিলাম। আমার মনে হয়েছিল আমার পৃথিবী শেষ হয়ে গেছে। মেয়েটি যদি আমাকে সংক্রামিত করে এবং আমি আমার পরিবারকে সংক্রামিত করি তবে কী হবে?
সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম জামাল বলেন, যখন কানাডা-ফেরত মেয়েটির আসার খবর জানাজানি হয়, তখন ওয়ার্ডটি আতঙ্কিত পড়ে যায়। তবে এর পরেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়।
ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন বলেন, রোগীর ওয়ার্ডে দায়িত্বরত স্টাফদের ভাইরাস প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছিল না। তারা উদ্বিগ্ন ছিলেন হয়তো রোগীর সংস্পর্শে আসলে করোনা ভাইরাসে নিজেরাও আক্রান্ত হবেন। এছাড়া কোনও করোনা ভাইরাস পরীক্ষার কিট ছিল না এবং এমনকি তার শরীরে ভাইরাস রয়েছে কিনা তাও নিশ্চিত করতে পারেনি। তিনি বলেন, মেয়েটির করোনা পরীক্ষার করার জন্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) ফোন করা হয়। সেখান থেকে প্রতিনিধি এসে তার শরীর পরীক্ষা করে এবং করোনা নেগেটিভ পাওয়া যায়। অর্থাৎ মেয়েটি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নন। এদিকে রোগীর কোন পর্যবেক্ষণ ছাড়া প্রায় এক ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। তাই মেয়েটির অবস্থা অবনতির দিকে চলে যায়। তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় বলে গণমাধ্যমকে জানান ঢামেকের পরিচালক।
হাসপাতাল সূত্র জানা যায়, দুপুর প্রায় সাড়ে ১২ টার দিকে একজন চিকিৎসক এগিয়ে গেলেন, গ্লাভস এবং মুখোশ পরে রোগীকে অ্যান্টিবায়োাটিকযুক্ত ইনজেকশন পুশ করেন। তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক পুশ হওয়ার পরই নাজমা মারা যান। সন্দেহ করা হচ্ছে তার অন্ত্রের ছিদ্র ছিল, যার অর্থ তার অন্ত্রের কোথাও একটি ফাটল ছিল। যখন তাকে ভর্তি করা হয়েছিল, তখন তিনি প্রচুর শরীরের তরল হারিয়েছিলেন এবং হাইপারভাইলেমিক শক পেয়েছিলেন। অর্থাৎ পালস দুর্বল ছিলো, রক্তচাপ কম ছিলো, শরীরের তাপমাত্রা কমে গিয়ে ছিল, শ্বাস প্রশ্বাস জোরে জোরে নিচ্ছিল।